৫. বাক্যতত্ত্ব

বাক্য: একাধিক অর্থপূর্ণ পদকে পাশাপাশি ব্যবহার করে বক্তার মনোভাব যদি সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়, তবে তাকে বাক্য (Sentence) বলে। 

একটি সার্থক/আদর্শ বাক্যের তিনটি বৈশিষ্ট বা গুণ থাকা আবশ্যক। যথা: (১) আকাঙ্ক্ষা (২) আসত্তি এবং (৩) যোগ্যতা। 

(১) আকাঙ্ক্ষা (Expectancy): বাক্যের অর্থ পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য এক পদের পর অন্য পদ শোনার যে ইচ্ছা বা আগ্রহ, তা-ই আকাঙ্ক্ষা। যেমন ‘‘চন্দ্র পৃথিবীর চারিদিকে’’- বললে বাক্যটি সম্পূর্ণ মনোভাব প্রকাশ করে না। আরও কিছু শোনার ইচ্ছা বা আগ্রহ থেকে যায়। যদি বলা হতো “চন্দ্র পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে”, তাহলে এটিকে পূর্ণাঙ্গ বাক্য বলা যেতো। কেননা এখানে আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি হয়েছে। 

(২) আসত্তি (Proximity): বাক্যের অর্থ সঙ্গতি রক্ষার জন্য সুশৃঙ্খল পদ-বিন্যাসই হলো আসত্তি। অর্থাৎ মনোভাব প্রকাশের জন্য বাক্যে শব্দগুলো এমনভাবে পরপর সাজাতে হবে যেন মনোভাব প্রকাশ বাধাগ্রস্ত না হয়। যেমন: “জেলেরা মাছ দিয়ে জাল ধরে”- এখানে পদ সন্নিবেশ ঠিকমতো না হওয়ায় শব্দগুলোর অন্তর্নিহিত ভাবটি যথাযথ প্রকাশিত হয়নি। তাই এটি সার্থক বাক্য হয়নি। মনোভাব পূর্ণভাবে প্রকাশ করার জন্য পদগুলোকে নিম্ন লিখিত ভাবে যথাস্থানে বিন্যাস করলে হবে- “জেলেরা জাল দিয়ে মাছ ধরে”। এ বাক্যটি আসত্তি সম্পন্ন এবং সার্থক।

(৩) যোগ্যতা (Propriety): বাক্যাস্থিত পদ সমূহের অর্থগত এবং ভাবগত মেলবন্ধনের নাম যোগ্যতা। যেমন- “আকাশেতে উড়ে গেল এক পাল হাতি”- এটি সার্থক বাক্য হয়নি। কারণ হাতির পক্ষে ওড়া সম্ভব নয়। এখানে পদসমূহের মধ্যে অর্থগত ও ভাবগত মিল নেই। কিন্তু যদি বলা হয়- “আকাশেতে উড়ে গেল এক ঝাঁক পাখি”। তাহলে এটি যোগ্যতা সম্পন্ন বাক্য হতো। কারণ এ বাক্যে অর্থগত ও ভাবগত সমন্বয় আছে।

বাক্য: একাধিক অর্থপূর্ণ পদকে পাশাপাশি ব্যবহার করে বক্তার মনোভাব যদি সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়, তবে তাকে বাক্য (Sentence) বলে। 

গঠন অনুসারে বাক্যকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা: (১) সরল বাক্য, (২) জটিল বাক্য এবং (৩) যৌগিক বাক্য।

১। সরল বাক্য: যে বাক্যে একটি মাত্র কর্তা (উদ্দেশ্য) এবং একটি মাত্র সমাপিকা ক্রিয়া (বিধেয়) থাকে, তাকে সরল বাক্য বলে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘একটি সমাপিকা ক্রিয়াবিশিষ্ট’ বাক্যকেই ‘সরল’ বাক্য বলেছেন। যেমন- সুমন বই পড়ে। এখানে ‘সুমন’ কর্তা এবং ‘পড়ে’ সমাপিকা ক্রিয়া। 

২। মিশ্র বা জটিল বাক্য: একটি প্রধান বাক্য এবং তার ওপর নির্ভরশীল এক বা একাধিক আশ্রিত বাক্য পরস্পর সাপেক্ষভাবে ব্যবহৃত হয়ে যে বাক্য গঠন করে, তাকে জটিল বা মিশ্র বাক্য বলে। জটিল বাক্যগুলো সাপেক্ষ সর্বনাম- যেমন-তেমন, যা-তা, যেহেতু-সেহেতু, যদি-তবে, যারা-তারা ইত্যাদি দ্বারা সংযুক্ত হয়। যেমন- যে পরিশ্রম করে (আশ্রিত বাক্য),সেই সুখ লাভ করে (প্রধান ও খণ্ড বাক্য); সেই সত্য, যা রচিবে তুমি।

৩। যৌগিক বাক্য : পরস্পর নিরপেক্ষ দুই বা ততোধিক সরল বা মিশ্র বাক্য মিলিত হয়ে একটি সম্পূর্ণ বাক্য গঠন করলে তাকে যৌগিক বাক্য বলে। যৌগিক বাক্যের অন্তর্গত স্বাধীন বাক্যগুলো এবং, ও, অথবা, বরং, কিংবা, কিন্তু, তথাপি, সুতরাং ইত্যাদি অব্যয় দ্বারা পরস্পর যুক্ত হয়। যেমন : বিপদ এবং দুঃখ একই সাথে আসে। লোকটি গরিব কিন্তু সৎ; উদয়ান্ত পরিশ্রম করব তথাপি অন্যের দ্বারস্থ হব না।

বাক্য: একাধিক অর্থপূর্ণ পদকে পাশাপাশি ব্যবহার করে বক্তার মনোভাব যদি সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়, তবে তাকে বাক্য (Sentence) বলে। 

অর্থ অনুসারে বাংলা বাক্যসমূহকে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সাতটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা:

১। বিবৃতিমূলক বা বর্ণনাত্মক বা নির্দেশাত্মক বাক্য: যে বাক্যে কোনো ঘটনার ভাব বা তথ্য, বিষয় বা বক্তব্যকে সাধারণভাবে বিবৃত, বর্ণনা বা নির্দেশ করা হয়, তাকে বিবৃতিমূলক বা বর্ণনাত্মক বা নিদের্শাত্মক বাক্য বলে। যেমন:  বৃক্ষের দিকে তাকালে জীবনের তাৎপর্য উপলব্ধি সহজ হয়।    বৃক্ষের দিকে তাকালে জীবনের তাৎপর্য উপলব্ধি করা কঠিন হয় না।

২। প্রশ্নবোধক বাক্য: যে ধরনের বাক্যে কোন বিষয় সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা বা প্রশ্নসূচক অর্থ প্রকাশ পায়, তাকে প্রশ্নবোধক বাক্য বলে। যেমন:  আরিফের সঙ্গে তার চেহারার কোন মিল আছে কি?  
     জাতীয় জাদুঘর কি একটি জাতিসত্তার পরিচয় বহন করে না?      জাতীয় জাদুঘর কোথায় অবস্থিত?         তোমরা মনুষ্য আমরা বিড়াল প্রভেদ কী?

৩। অনুজ্ঞাসূচক বাক্য: যে বাক্যে আদেশ, উপদেশ, অনুরোধ, নিষেধ, প্রস্তাব ইত্যাদি প্রকাশ পায়, তাকে অনুজ্ঞাসূচক বাক্য বলে।  যেমন: ঘর থেকে বের হয়ে যাও। অযথা ঋণ করিও না।

৪। আবেগসূচক বা বিস্ময়সূচক বাক্য: যে বাক্য দ্বারা মনের আকস্মিক আবেগ অর্থাৎ বিস্ময়, হর্ষ, বিষাদ, ঘৃণা, ভয়, শোক ইত্যাদি প্রকাশ পায়, তাকে আবেগসূচক বাক্য বলে। যেমন: কী বিচিত্র এই দেশ!         বাঃ! কী সুন্দর দৃশ্য!

৫। ইচ্ছাসূচক বা প্রার্থনামূলক বাক্য: যে বাক্য দ্বারা বক্তার মনের ইচ্ছা, প্রার্থনা, কামনা বা আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পায়, তাকে প্রার্থনামূলক বা ইচ্ছাসূচক বাক্য বলে। যেমন: ইস! যদি পাখির মতো পাখা পেতাম।
এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।    তুমি দীর্ঘায়ু হও।

৬। সন্দেহবাচক বা সংশয়বাচক বাক্য: বুঝি, বোধ হয়, যেন, হয়তো ইত্যাদি এক বা একাধিক শব্দের ব্যবহারে বক্তার মনের সন্দেহ বা সংশয় বা অনুমান প্রকাশিত হয় যে বাক্যে, তাকে সন্দেহবাচক বা সংশয়বাচক বাক্য বলে। যেমন: তোমরা বুঝি এ বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছো।   হয়তো সুমন আসতে পারে।

৭। শর্তবাচক বা কার্যকারণাত্মক বাক্য: যে বাক্যে কার্যের কোনো কারণ বা শর্ত উল্লেখ থাকে কিংবা একটি ঘটনা বা অবস্থার ওপর অন্য একটি ঘটনা বা অবস্থার নির্ভরশীলতা ব্যক্ত হয়, তাকে শর্তবাচক বা কার্যকারণাত্মক বাক্য বলে। যেমন: বৃষ্টি হলে ফসল ভালো হবে।  মনোযোগসহকারে পড়ালেখা করলে সাফল্য আসবে।


_

_