রেইনকোট

রেইনকোট
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস


লেখক পরিচিতি:
নাম : আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।
পিতৃপ্রদত্ত নাম : আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস।
জন্ম ও পরিচয় : ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দ। তিনি গাইবান্ধা জেলার গোটিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক নিবাস বগুড়া জেলার নারুলি গ্রাম।
পিতার নাম : বি.এম. ইলিয়াস।
মাতার নাম : মরিয়ম ইলিয়াস।
শিক্ষাজীবন : তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্মজীবন : তিনি সরকারি কলেজের বাংলা বিষয়ের অধ্যাপক ছিলেন।
সাহিত্যকর্ম : গল্পগ্রন্থ : ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’, ‘খোয়ারি, ‘দুধভাতে উৎপাত’, ‘দোজখের ওম’, ‘জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল'।
উপন্যাস : চিলেকোঠার সেপাই, খোয়াবনামা।

জীবনাবসান : ৪ জানুয়ারি, ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।



ভোররাত থেকে বৃষ্টি। আহা! বৃষ্টির ঝমঝম বোল। এই বৃষ্টির মেয়াদ আল্লা দিলেপুরো তিনদিন 🔒ব্যাখ্যা। কারণ শনিতে সাত মঙ্গলে তিন, আর সব দিন দিন। 🔒ব্যাখ্যা এটা জেনারেল স্টেটমেন্টস্পেসিফিক ক্ল্যাসিফিকেশনও আছে। যেমন, মঙ্গলে ভোররাতে হইল শুরু, তিন দিন মেঘের গুরুগুরু। তারপর, বুধের সকালে নামল জল, বিকালে মেঘ কয় এবার চল। বৃহস্পতি শুক্র কিছু বাদ নাই। কিন্তু এখন ভুলে গেছে। যেটুকু মনে আছে, পুরু বেড-কভারের নিচে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আর-একপশলা ঘুমিয়ে নেওয়ার জন্যে তাই যথেষ্ট। অন্তত তিন দিন ফুটফাট বন্ধ। বাদলায় বন্দুক-বারুদ কি একটু জিরিয়ে নেবে না? 🔒ব্যাখ্যা এই কটা দিন নিশ্চিন্তে আরাম করো।
তা আর হলো কই? ম্যান প্রোপোজেস-। এমন চমৎকার বাদলার সকালে দরজায় প্রবল কড়া নাড়া শেষ হেমন্তের শীত শীত পর্দা ছিঁড়ে ফালাফালা করে ফেলল। সব ভেস্তে দিল। মিলিটারি! মিলিটারি আজ তার ঘরে। আল্লা গো। আল্লাহুম্মা আন্তা সুবহানকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ জোয়ালেমিন। -পড়তে পড়তে সে দরজার দিকে এগোয়। 🔒ব্যাখ্যা এই কয়েক মাসে কত সুরাই সে মুখস্থ করেছে। 🔒ব্যাখ্যা রাস্তায় বেরুলে পাঁচ কালেমা সব সময় রেডি রাখে ঠোঁটের ওপর। 🔒ব্যাখ্যা কোনদিক থেকে কখন মিলিটারি ধরে। -তবু একটা না একটা ভুল হয়েই যায়। দোয়া মনে হলো ঠিকই কিন্তু টুপিটা মাথায় দিতে ভুলে গেল।
দুটো ছিটকিনি, একটা খিল এবং কাঠের ডাশা খুলে দরজার কপাট ফাঁক করতেই বাতাস আর বৃষ্টির ঝাপ্‌টার সঙ্গে ঘরে ঢোকে প্রিন্সিপ্যালের পিওন। আলহামদুলিল্লাহ! মিলিটারি নয়। পিওনকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে ইচ্ছা করছে। 🔒ব্যাখ্যা কিন্তু লোকটার চিনচিনে গলা গম্ভীর স্বরে হাঁকে,“স্যার নে সালাম দিয়া।” বলেই ভাঙাচোরা গালের খোঁচাখোঁচা দাড়িতে লোকটা নিজের বাক্যের কোমল শাঁসটুকু শুষে নেয় এবং হুকুম ছাড়ে,“তলব কিয়া। আভি যানে হোগা।”
কী ব্যাপার?
বেশি কথা বলার সময় নাই-কলেজের দেওয়াল ঘেঁষে কারা বোমা ফাটিয়ে গেছে গত রাতে। 
মানে? 
মিসকিরিয়ান লোগ ইলেকটিরি টেরানসফার্মার তোড় দিয়া। অওর অয়াপস যানেকা টাইম পিরিনসিপাল সাহাবকা কোঠিমে গেরেনড ফেকা। গেট তোড় গিয়া।”
ভয়াবহ কাণ্ড। ইলেকট্রিক ট্রান্সফর্মার তো কলেজের সামনের দেওয়াল ঘেঁষে। দেওয়ালের পর বাগান, টেনিস লন। তারপর কলেজ দালান। মস্ত দালান পার হয়ে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার মাঠ। মাঠ পেরিয়ে একটু বাঁ দিকে প্রিন্সিপ্যালের কোয়ার্টার। এর সঙ্গে মিলিটারি ক্যাম্প। কলেজের জিমন্যাশিয়ামে এখন মিলিটারি ক্যাম্প। 🔒ব্যাখ্যা প্রিন্সিপ্যালের বাড়ির গেটে বোমা ফেলা মানে মিলিটারি ক্যাম্প অ্যাটাক করা। 🔒ব্যাখ্যা সামনের দেওয়ালে বোমা মেরে এতটা পথ ক্রস করে গেল কী করে? 🔒ব্যাখ্যা সে জানতে চায়,“ক্যায়সে?” 
প্রিনসিপ্যালের পিওন জানবে কী করে? “উও আপ হি কহ সকতা।”  🔒ব্যাখ্যা
মানে? সে-ই বা বলবে কী করে? পিওন কি তাকে মিসক্রিয়ান্টদের লোক ভাবে নাকি?-তার মাথাটা আপনাআপনি নিচু হলে মুখ দিয়ে পানির মতো গড়িয়ে পড়ে,“ইসহাক মিয়া, বৈঠিয়ে চা টা খাইয়ে। আমার এই পাঁচ সাত মিনিট লাগেগা।” 
‘নেহি।’ নাশতার আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়ে 🔒ব্যাখ্যা ইসহাক বলে,“আব্দুস সাত্তার মিরধাকা ঘর যানে হোগা। আপ আভি আইয়ে। এক কর্নেল সাহাব পঁওছ গিয়া। সব পরফসরকো এত্তেলা দিয়া। ফওরন আইয়ে।” 
কর্নেলের নেতৃত্বে মিলিটারির হাতে কলেজটা এবং তাকেও ন্যস্ত করে ইসহাক বেরিয়ে যায়, রাস্তায় ঘড়ঘড় করতে থাকা বেবি ট্যাকসির গর্জন তুলে সে রওয়ানা হলো জিওগ্রাফির প্রফেসরের বাড়ির দিকে। ইসহাক নিজেই এখন মিলিটারির কর্নেল বললেও চলে। 🔒ব্যাখ্যা তবে ভোরবেলা কলেজের ভেতরে কর্নেল খোদ চলে আসায় সে হয়ত ডেমোটেড হয়েছে লেফটেন্যান্ট কর্নেলে। আরও নিচেও নামাতে পারে। কিন্তু ক্যাপ্টেনের এদিকে তাকে ঠেলা মুশকিল। 🔒ব্যাখ্যা মিলিটারি প্রাদুর্ভাবের পর থেকে তাকে দেখে কলেজের সবাই তটস্থ। 🔒ব্যাখ্যা এপ্রিলের শুরু থেকে সে বাংলা বলা ছেড়েছে। কোনকালে দাদা না পরদাদার ভায়রার মামু না কে যেন দিল্লিওয়ালা কোন সাহেবের খাস খানসামা ছিল, সেই সুবাদে দিনরাত এখন উর্দু বলে। 🔒ব্যাখ্যা
“যেতেই হবে? অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজে তোমার হাঁপানির টানটা আবার-।” বৌয়ের এসব সোয়াগের কথা শুনলে কি তার চলবে? বৌ কি প্রিনসিপ্যালের ধমকের ভাগ নেবে? এর ওপর কলেজে কর্নেল এসেছে। কপালে আজ কী আছে আল্লাই জানে! 🔒ব্যাখ্যা ফায়ারিং স্কোয়াডে যদি দাঁড় করিয়েই দেয় তো কর্নেল সাহেবের হাতে পায়ে ধরে ঠিক কপালে গুলি করার হুকুম জারি করানো যায় না? প্রিনসিপ্যাল কি তার জন্যে কর্নেলের কাছে এই তদবিরটুকু করবে না? পাকিস্তানের জন্যে প্রিনসিপ্যাল দিনরাত দোয়া-দরুদ পড়ছে। সময় নাই অসময় নাই আল্লার দরবারে কান্নাকাটি করে 🔒ব্যাখ্যা এবং সময় করে কলিগদের গালাগালিও করে। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি প্রিনসিপ্যাল মিলিটারির বড়ো কর্তাদের কাছে সবিনয়ে নিবেদন করেছিল, পাকিস্তান যদি বাঁচাতে হয় তো সব স্কুলকলেজ থেকে শহিদ মিনার হটাও। 🔒ব্যাখ্যা এগুলো হলো পাকিস্তানের শরীরের কাঁটা। 🔒ব্যাখ্যা পাকিস্তানের পাক সাফ শরীরটাকে নীরোগ করতে হলে এসব কাঁটা ওপড়াতে হবে। তা মিলিটারি ডক্টর আফাজ আহমদের পরামর্শ শুনেছে, গ্রামে-গঞ্জে যেখানেই গেছে প্রথমেই কামান তাক করছে শহিদ মিনারের দিকে। দেশের একটা কলেজে শহিদ মিনার আর অক্ষত নাই। 🔒ব্যাখ্যা তা প্রিনসিপ্যাল তাদের এত বড়ো একটা পরামর্শ দিল,আর সামান্য এক লেকচারারকে গুলি করার সময় শরীরের আলতুফালতুজায়গা বাদ দিয়ে কপালটা টার্গেট করার অনুরোধটা তার মানবে না? 🔒ব্যাখ্যা আবার প্রিনসিপ্যালকে সে এত সার্ভিস দিচ্ছে,তার কলিগের, তওবা, সাব-অর্ডিনেটের জন্যে এতটুকু করবে না? 
প্যান্টের ভেতর পা গলিয়ে দিতে দিতে সে শোনে রান্নাঘর থেকে বৌ বলছে,“তাড়াতাড়ি চলে এসো। বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে মিরপুর ব্রিজের দিক থেকে গুলির আওয়াজ আসছিল। কখন কী হয়।”
এসব কথা এখন বলার দরকারটা কী? -রেডিও টেলিভিশনে হরদম বলছে, সিচুয়েশন নর্ম্যাল। 🔒ব্যাখ্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক। দুশমনকে সম্পূর্ণ কব্‌জা করা গেছে। মিসক্রিয়েন্টরা সব খতম। প্রেসিডেন্ট দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। কিছুদিন বাদে বাদে তার ভাষণ শোনা যায়, আওয়ার আলটিমেট এইম রিমেইনস দ্য সেম, দ্যাট ইজ টু হ্যান্ডওভার পাওয়ার টু দি ইলেকটেড রিপ্রেজেনটেটিভ্‌স অব দ্য পিপল। সবই তো নর্ম্যাল হয়ে আসছে। বাঙালি, আই মিন, ইস্ট পাকিস্তানি গভর্নর, মন্ত্রীরা ইস্ট পাকিস্তানি। সবই তো স্বাভাবিক। এখন বৌ তার এসব বাজে কথা বলে কেন? ইস! আসমাকে নিয়ে পারা যায় না। 
“এই বৃষ্টিতে শুধু ছাতায় কুলাবে না গো।” বৌয়ের আরেক দফা সোয়াগ শোনা গেল,“তুমি বরং মিন্টুর রেইনকোটটা নিয়ে যাও।”
ইস! আবার মিন্টু। বৌয়ের এই ভাইটার জন্যেই তাকে এক্সট্রা তটস্থ হয়ে থাকতে হয়। বাড়ি থেকে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তার মগবাজারের দুই কামরার ফ্ল্যাট থেকেই তো মিন্টু চলে গেল জুন মাসে, জুনের ২৩ তারিখে। জুলাইয়ের পয়লা তারিখে সে বাড়ি শিফট করল। 🔒ব্যাখ্যা বলা যায় না, ওখানে যদি কেউ কিছু আঁচ করে থাকে। ও চলে যাবার তিনদিন পরেই পাশের ফ্ল্যাটের গোলগাল মুখের মহিলা তার বৌকে জিগ্যেস করেছিল, “ভাবি, আপনার ভাইকে দেখছি না।” ব্যস, এই শুনেই সে বাড়ি বদলাবার জন্যে লেগে গেল হন্যে হয়ে। মিলিটারি লাগার পর থেকে এই নিয়ে চারবার বাড়ি পাল্টানো হলো। 🔒ব্যাখ্যা এখানে আসার পর নিচের তলার ভদ্রলোক একদিন বলছিল, “আমার ভাইটাকে আর ঢাকায় রাখলাম না। যে গোলমাল, বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম।” শুনে বুকটা তার টিপটিপ করছিল, এবার যদি তার শালার প্রসঙ্গ তোলে? নিরাপত্তার জন্যেই সে এখানে এসেছে। কলেজ থেকে দূরে, আত্মীয়স্বজন থেকে দূরে। শহর থেকেও দূরেই বলা যায়। ভেবেছিল নতুন এলাকা, পুবদিকে জানলা ধরে দাঁড়ালে চোখে পড়ে বিল আর ধানক্ষেত। তা কী বিপদ! এদিকে নাকি নৌকা করে চলে আসে স্টেনগানওয়ালা ছোকরার দল। এদিককার মানুষ চোখে খালি নৌকা দেখে, নৌকা ভরা অস্ত্র। এর ওপর বৌ যদি মিন্টুর কথা তোলে তো অস্ত্র ঢুকে পড়ে তার ঘরের মধ্যিখানে। 🔒ব্যাখ্যা মিন্টু যে কোথায় গেছে তা সে-ও জানে তার বৌ-ও জানে। কিসিনজার সাহেব বলেছে, এসব হলো পাকিস্তানের ইনটার্নাল অ্যাফেয়ার। 🔒ব্যাখ্যা -মানুষ মেরে সাফ করে দেয়, বাড়িঘর, গ্রাম, বাজারহাট জ্বালিয়ে দিচ্ছে, -কারো কোনো মাথাব্যথা নাই। এসব হলো ইনটার্নাল অ্যাফেয়ার। -না, না, এ ধরনের ভাবনা ধারে কাছে ঘেঁষতে দেওয়াও ঠিক নয়। নিচের ফ্ল্যাটে থাকে ওয়েলডিং ওয়ার্কশপের মালিক, তার শ্বশুর নিশ্চয়ই সর্দার গোছের রাজাকার। 🔒ব্যাখ্যা সপ্তাহে দুইদিন-তিনদিন মেয়ের বাড়িতে রেফ্রিজারেটর, টেপ রেকর্ডার, দামি দামি সোফাসেট, ফ্যান, খাট-পালং সব চালান পাঠায়।
“দেখি তো, ফিট করে কিনা।” আসমা এগিয়ে এসে তার গায়ে রেইনকোট চড়িয়ে দিতে দিতে বলে, “মিন্টু তো আমার চেয়ে অনেক লম্বা। তোমার গায়ে হবে তো?” -দেখো, ফের মিন্টুর দৈর্ঘ্যরে তুলনা করে তার সঙ্গে। এই ভাইকে নিয়ে এরকম বাড়াবাড়ি করাটা কি আসমার ঠিক হচ্ছে? 
“ভালোই হলো। তোমার গোড়ালি পর্যন্ত ঢাকা পড়েছে। পায়েও বৃষ্টি লাগবে না।” এখানেই আসমার শেষ নয়। রেইনকোটের সঙ্গেকার টুপি এনে চড়িয়ে দেয় তার মাথায়। 
“আব্বু ছোটোমামা হয়েছে। আব্বু ছোটোমামা হয়েছে।” 🔒ব্যাখ্যা আড়াই বছরের মেয়ের সদ্য-ঘুম-ভাঙা গলায় ভাঙা ভাঙা বুলি শুনে সে চমকে ওঠে, মিন্টু কি ঢুকে পড়লো অস্ত্রশস্ত্র হাতে? এর মানে পিছে পিছে ঢুকছে মিলিটারি। তার মানে-। না, দরজার ছিটকিনি ও খিল সব বন্ধ। 
তাকে কি মিন্টুর মতো দেখাচ্ছে? মিলিটারি আবার ভুল করে বসবে না তো? 🔒ব্যাখ্যা এর মধ্যে তার পাঁচ বছরের ছেলেটা গম্ভীর চোখে তাকে পর্যবেক্ষণ করে রায় দেয়, “আব্বুকে ছোটোমামার মতো দেখাচ্ছে। আব্বু তা হলে মুক্তিবাহিনী। তাই না?” 🔒ব্যাখ্যা
এ তো ভাবনার কাথা। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের নতুনরূপে সে ভ্যাবাচ্যাকা খায়। 🔒ব্যাখ্যা না-! খামাখা ভয় পাচ্ছে। বৃষ্টির দিনে রেইনকোট গায়ে দেওয়াটা অপরাধ হবে কেন? মিলিটারির কি আর বিবেচনাবোধ নাই? প্রিনসিপ্যাল ড. আফাজ আহমদ ঠিকই বলে,“শোনেন,মিলিটারি যাদের ধরে,মিছেমিছি ধরে না। সাবভার্সিভ অ্যাকটিভিটিজের 🔒ব্যাখ্যা সঙ্গে তারা সামহাউ অর আদার ইন্‌ভলভ্‌ড।” তা সে তো বাপু এসব থেকে শতহাত দূরে। শালা তার বর্ডার ক্রস করল, ফিরে এসে দেশের ভেতরে দমাদম মিলিটারি মারে। তাতে আর দুলাভাইয়ের দোষটা কোথায়? এই যে মিলিটারি প্রত্যেকদিন এই ঢাকা শহরের বাজার পোড়ায়, বস্তিতে আগুন লাগিয়ে টপাটপ মানুষ মারে, মেয়েদের ধরে নিয়ে যায়, -সে কখনো এসব নিয়ে টুঁ শব্দটি করেছে? কলেজের দেওয়াল ঘেঁষে প্রিনসিপ্যালের কোয়ার্টারের পাশে মিলিটারি ক্যাম্প, ক্লাস সব বন্ধ। ছেলেরা কেউ আসে না। মাস্টারদের হাজিরা দিতে হয়, তাও বহু টিচার গা ঢাকা দিয়েছে কবে থেকে। সে তো রোজ টাইম্‌লি যায়। 🔒ব্যাখ্যা স্টাফ রুমে কলিগরা ফিসফিস করে, কোথায় কোন ব্রিজ উড়ে গেল, কোথায় সাত মিলিটারির লাশ পড়েছে ছেলেদের গুলিতে, এই কলেজের কোন কোন ছেলে ফ্রন্টে গেছে, -কই, সে তো এসব আলাপের মধ্যে কখনো থাকে না। এসব কথা শুরু হলেই আলগোছে উঠে সে চলে যায় প্রিনসিপ্যালের কামরায়। ড. আফাজ আহমদের খ্যাসখ্যাস গলায় হিন্দুস্তান ও মিসক্রিয়েন্টদের আশু ও অবশ্যম্ভাবী পতন সম্বন্ধে নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী শোনে। ওই ঘরে আজকাল সহজে কেউ ঘেঁষে না। 🔒ব্যাখ্যা উর্দুর প্রফেসর আকবর সাজিদকে প্রিনসিপ্যাল আজকাল তোয়াজ করে। 🔒ব্যাখ্যা
মিন্টুর ফেলে-যাওয়া নাকি রেখে-যাওয়া রেইনকোটে ঢোকার পর থেকে তার পা শিরশির করছে, 🔒ব্যাখ্যা আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। প্রিনসিপ্যাল তাকে ডেকে পাঠিয়েছে সেই কখন!
রাস্তায় একটা রিকশা নাই। তা রিকশার পরোয়াও সে এখন করছে না। রেইনকোটের ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে বাসস্ট্যান্ড যেতে তার কোনো অসুবিধে হবে না। রেইনকোটের ওপর বৃষ্টি পড়ছে অবিরাম। কী মজা, তার গায়ে লাগে না একটি ফোঁটা। টুপির বারান্দা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লে কয়েক ফোঁটা সে চেটে দেখে। ঠিক পানসে স্বাদ নয়, টুপির তেজ কি পানিতেও লাগল নাকি? তাকে কি মিলিটারির মতো দেখাচ্ছে? পাঞ্জাব আর্টিলারি, না বালুচ রেজিমেন্ট, না কম্যান্ডো ফোর্স, নাকি প্যারা মিলিটারি, না মিলিটারি পুলিশ,-ওদের তো একেক গুষ্টির একেক নাম, একেক সুরত। তার রেইনকোটে তাকে কি নতুন কোনো বাহিনীর লোক বলে মনে হচ্ছে? হোক। সে বেশ হনহন করে হাঁটে। শেষ- হেমন্তের বৃষ্টিতে বেশ শীত-শীত ভাব। কিন্তু রেইনকোটের ভেতরে কী সুন্দর ওম। মিন্টুটা এই রেইনকোট রেখে গিয়ে কী ভালোই যে করেছে। 🔒ব্যাখ্যা
বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে বাসের জন্য তাকে তাকাতে হয় উত্তরেই। মিলিটারি লরির ল্যাজটাও দেখা যাচ্ছে না। আবার তার বাসেরও তো নামগন্ধ নেই। বাসস্ট্যান্ডে জনপ্রাণী বলতে সে একেবারে একলা। রাস্তার পাশে পান-বিড়ি-সিগ্রেটের ছোট দোকানটার ঝাঁপ একটুখানি তুলে দোকানদারও তাকিয়ে রয়েছে উত্তরেই, ওদিকে কি কোনো গোলমাল হলো নাকি? দোকানদার ছেলেটা একটু বাচাল টাইপের। বাসস্ট্যান্ডে তাকে দেখলেই ছোঁড়াটা বিড়বিড় করে,কাল শোনেন নাই? মিরপুরের বিল দিয়া দুই নৌকা বোঝাই কইরা আইছিল। একটা জিপ উড়াইয়া দিছে, কমপক্ষে পাঁচটা খানসেনা খতম। বিবিসি কইছে,রংপুর-দিনাজপুরের হাফের বেশি জায়গা স্বাধীন। এর মধ্যেই ছিপছিপে বৃষ্টিতে লালচে আভা তুলে এসে পড়ল লাল রঙের স্টেট বাস।
বাসে যাত্রী কম। না, না, কন্ডাক্টররা সবসময় যেমন-খালি-গাড়ি বলে চ্যাঁচায়,সেরকম নয়। সত্যি সত্যি অর্ধেকের বেশি সিট খালি। সে বাসে উঠলে তার রেইনকোটের পানি পড়তে লাগল বাসের ভিজে মাটিতে। এ জন্যে তার একটু খারাপ কথা,অন্তত টিটকারি শোনার কথা। কিন্তু তাকে কেউ কিছু বলে না। 
ঠোঁটে তার একটু হাসি বিছানো থাকে। 🔒ব্যাখ্যা এই নীরব কিন্তু স্পষ্ট হাসির কারণ কি এই যে, তার রেইনকোটের পানিতে বাসে সয়লাব হয়ে গেলেও কেউ টুঁ শব্দটি করছে না? তার পোশাক কি সবাইকে ঘাবড়ে দিল নাকি?
খালি রাস্তা পেয়ে বাস চলে খুব জোরে। কিন্তু তার আসনটি সে নির্বাচন করতে পারছে না। টলতে টলতে একবার এই সিট দেখে, পছন্দ হয় না বলে ফের ওই সিটের দিকে যায়। এমন সময় পেছনের দিক থেকে দুজন যাত্রী উঠে পড়ে তাড়াহুড়া করে, ‘রাখো রাখো’ বলতে বলতে ঝুঁকি নিয়ে তারা নেমে পড়ে চলন্ত বাস থেকে। সে তাদের দিকে তাকায় এবং বুঝতে পারে, এরা পালাল ঠিক তাকে দেখেই। লোক দুটো নিশ্চয়ই ক্রিমিনাল। একটা চোর, আরেকটা পকেটমার। কিংবা দুটোই চোর অথবা দুটোই পকেটমার। নামবার মুহূর্তে দুটোর মধ্যে সর্দার টাইপেরটা তার দিকে পেছন ফিরে তাকাল। সেই চোখ ভরা ভয়,কেবল ভয়। 🔒ব্যাখ্যা
জুৎসই সিট বেছে নিয়ে সে ধপাস করে বসতেই ফোমে ফস করে আওয়াজ হয় এবং তাতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় সামনের সিটে বসা তিনজন যাত্রী। হুঁ! এদেরও সে ঠিক চোর অথবা পকেটমার বলে ঠিক শনাক্ত করে ফেলে। ডাকাতও হতে পারে। কিংবা মিলিটারি কোনো বস্তিতে আগুন লাগিয়ে চলে এলে এরা ছোটে সেখানে লুটপাট করতে। অথবা মিলিটারি কোথাও লুটপাট করলে এরা গিয়ে উচ্ছিষ্ট কুড়ায়। তিনটেই পরের স্টপেজে নামার জন্যে অনেক আগেই ধরফর করে উঠে দাঁড়ায় এবং বাস থামার সঙ্গে-সঙ্গে নেমে পড়ে ঝটপট পায়। তিনটে ক্রিমিনালের একটাও তার দিকে আর ফিরেও তাকায় না। তার মানে তাকে বেশ ভয় পেয়েছে বলেই তার সঙ্গে চোখাচোখি এড়াতে এদের এত কসরত। 
যাক, মিন্টুর রেইনকোটে তার কাজ হচ্ছে। চোর ছ্যাঁচোর পকেটমার সব কেটে পড়ছে। ভালো মানুষেরা থাক। সে বেশ সৎসঙ্গে চলে যাবে একেবারে কলেজ পর্যন্ত। 🔒ব্যাখ্যা
আসাদ গেট বাসস্টপেজে ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল বেশ কয়েকজন মানুষ। ছাতা হাতে কেউ কেউ নিজ-নিজ ছাতার নিচে এবং ছাতা ছাড়া অনেকেই অন্যের ছাতার নিচে মাথার অন্তত খানিকটা পেতে দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট থেকে আত্মরক্ষা করতে শরীরগুলোকে আঁকাবাঁকা করছিল। বাস থামালে সে দেখল, একে একে নয়জন প্যাসেঞ্জার বাসে উঠল। সে বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবাইকে দেখে। তো তার দিকে তাকিয়ে নয়জনের তিনজন ‘আরে রাখো রাখো’ এবং একজন ‘রোখো-রোখো’ বলতে বলতে নেমে পড়ল ধড়ফড় করে। শেষের জন বোধ হয় এমনি অর্ডিনারি চোর, ছিঁচকে চোর হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আর প্রথম তিনটে কোথাও সুন্দরী মেয়ে মানুষ দেখলে মিলিটারিকে খবর দেয় কিংবা মিলিটারির কাছ থেকে বন্দুক নিয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে মহল্লায়-মহল্লায় ঘোরে আর সুন্দরী মেয়েদের ধরে এনে পৌঁছে দেয় মিলিটারি ক্যাম্পে। 🔒ব্যাখ্যা এগুলো হলো রাজাকার। 🔒ব্যাখ্যা ফের নতুন করে অপরাধীমুক্ত বাসে যেতে এখন ভালো লাগছে। 🔒ব্যাখ্যা জানালার বাইরে বৃষ্টি আঁশ উড়ছে; ঠাণ্ডা হাওয়ায় গাছপালা, লোকজন, দোকানপাট ও বাড়িঘরের ওপর ট্রান্সপারেন্ট আবরণ দেখে তার এক্সট্রা ভালো লাগে। সমস্ত ভালো-লাগাটা চিড় খায়, বাস হঠাৎ করে ব্রেক কষলো। 🔒ব্যাখ্যা তখন তাকে তাকাতে হয় বাঁয়ে, চোখ পড়ে নির্মীয়মাণ মসজিদের ছাদের দিকে, দরজা থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া এসে লাগে তার মুখে এবং নাকের ভেতর দিয়ে সেই হাওয়া ঢুকে পড়ে বুকে, সেখানে ধাক্কা লাগে; ক্রাক-ডাউনের রাত কেটে ভোর হলে মিলিটারির গুলিতে এই মসজিদের ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছিল মুয়াজ্জিন সাহেব। ঠাণ্ডা হওয়ার ধাক্কা রেইনকোটের তাপে এতটাই গরম হয়ে ওঠে যে, মনে হয় ভিতরে বুঝি আগুন ধরে গেল। মসজিদের উল্টোদিকের বাড়িতে তিনতলায় থাকত তখন তারা। রাতভর ট্যাঙ্কের হুঙ্কার আর মেশিনগান আর স্টেনগানের ঘেউঘেউ আর মানুষের কাতরানিতে তাদের কারও ঘুম হয়নি সে রাতে। ছেলেমেয়ে নিয়ে ছেলেমেয়ের মায়ের সঙ্গে সে শুয়েছিল খাটের নিচে। 🔒ব্যাখ্যা ভোরবেলা মিলিটারি মানুষ মারায় একটু বিরতি দিলে ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়ে এবং বন্ধ জানালার পর্দা একটু তুলে সে রাস্তা দেখতে থাকে। রাস্তার ওপরে মসজিদের ছাদে মুয়াজ্জিন সাহেব দাঁড়িয়েছিল আজান দিতে। সাধারণত জুমার নামাজটা সে নিয়মিত পড়ে। তবে সেই ভোরে তার আজান শুনতে ইচ্ছা করছিল খুব। মুয়াজ্জিনের আজান দেওয়াটা সম্পূর্ণ দেখবে বলে সে জানালার ধার থেকে সরে না। সারা এলাকায় ইলেক্‌ট্রিসিটি নষ্ট, মসজিদের মাইক্রোফোন অকেজো। মুয়াজ্জিন সাহেব গমগমে গলায় যতটা পারে জোর দিয়ে বলে উঠল ‘আল্লাহু আকবার’। দ্বিতীয়বার আল্লাহর মহত্ত ঘোষণা করার সুযোগ তার আর মেলেনি, 🔒ব্যাখ্যা এর আগেই সম্পূর্ণ অন্যরকম ধ্বনি করে লোকটা পড়ে যায় রাস্তার ওপর। সেদিন সকালে বৃষ্টি ছিল না। আজ বৃষ্টির সকালে মিলিটারি কি ওই দৃশ্যের পুনর্ঘটনের পাঁয়তারা করেছে? এখন তো কোনো নামাজের ওয়াক্ত নেই, তবে আজান দেওয়াবে কী করে? এরা বোধ হয় যে কোনো সময়কেই নামাজের ওয়াক্ত ঘোষণা করে নতুন হুকুম জারি করেছে।
মিলিটারি এখন যাবতীয় গাড়ি থামাচ্ছে। 🔒ব্যাখ্যা গাড়ির প্যাসেঞ্জারদের নামিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয় রাস্তার ধারে। আরেক দল মিলিটারি স্টেনগান তাক করিয়ে রেখেছে এই মানুষের সারির ওপর। অন্য একটি দল ফের ওই সব লোকের জামাকাপড় ও শরীরের গোপন জায়গাগুলো তল্লাসি করে। মিলিটারি যাদের পছন্দ করছে তাদের ঠেলে দিচ্ছে পেছনে দাঁড়ানো একটা লরির দিকে। তাদের বাসটিতে এসে উঠল লম্বা ও খুব ফর্সা এক মিলিটারি।
এখন বাসের ভিতর কোনো আওয়াজ নাই। যাত্রীদের বুকের টিপটিপ শব্দ এই নীরবতার সুযোগে বাড়ে এবং এটাই তার মাথায় বাজে দ্রাম-দ্রাম করে। বারান্দাওয়ালা টুপির নিচে শব্দের ঘষায় ঘষায় আগুন জ্বলে এবং তার হল্‌কা বেরোয় তার চোখ দিয়ে। তবে একটু নড়ে বসলে মাথার ও বুকের ধ্বনি নিয়ন্ত্রণে আসে এবং এসবকে পরোয়া না করে সে সরাসরি তাকাল মিলিটারির মুখের দিকে। মিলিটারির চোখ ছুঁচালো হয়ে আসে এবং ছুঁচালো চোখের মণি কাঁটার মতো বিঁধে যায় তার মুখে। সেও তার চোখের ভোঁতা কিন্তু গরম চাউনিটাকে স্থির করে আলগোছে বিছিয়ে দেয় মিলিটারির খাড়া নাকে, ছুঁটলো চোখে, গোঁফের নিচে ও নাক, গোঁফ ও চোখের আশপাশের ও নিচের লালচে চামড়ায়। এতে কাজ হলো। মিলিটারির চোখা চোখ সরে যায় তার মুখ থেকে, নেমে পড়ে তার রেইনকোটের ওপর। মনে হয় রেইনকোটের পানির ফোঁটাগুলো লোকটা গুণে গুণে দেখছে। ভেতরের তাপে এইসব পানির ফোঁটা দেখে মিলিটারির এত থ মেরে যাবার কী হলো? লোকটা কি এগুলোতে রক্তের চিহ্ন দেখে? রেইনকোটের বৃষ্টির ফোঁটা গোণাগুনতি সেরে মিলিটারি হঠাৎ বলে, ‘আগে বাড়ো’। বাস হঠাৎ স্টার্ট দিয়ে কয়েক পা লাফিয়ে আগে বাড়ে এবং যাত্রীদের স্বস্তির নিঃশ্বাসের ধাক্কায় অতিরিক্ত বেগে ছুটে পার হয়ে যায় ঢাকা কলেজের গেট। নিউ মার্কেটের সামনে এসে পড়লে সে উঠে দাঁড়ায় এবং হুকুম করে, ‘রাখেন নামবো’। বাস একটু স্লো হলে তার রেইনকোটের জমানো পানি গড়িয়ে পড়তে দিয়ে অপরাধীমুক্ত বাস থেকে নামতে নামতে সহযাত্রীদের দিকে তাকিয়ে সে ঠোঁট বাঁকায়, এতে তার সামনের সারি দাঁতও বেরিয়ে পড়ে। যারা দেখেছে তারা তার সেই ভঙ্গিটিকে ঠিক হাসি বলে শনাক্ত করতে পেরেছিল বলে তার ধারণা হয়।
প্রিন্সিপালের কামরায় প্রিন্সিপালের সিংহাসন মার্কা চেয়ারে বসে রয়েছে জাঁদরেল টাইপের এক মিলিটারি পান্ডা। তার ভারিক্কি মুখ থেকে অনুমান করা যায়, পান্ডাটি কর্নেল কিংবা মেজর জেনারেল, অথবা মেজর বা ব্রিগেডিয়ার। তাকে দেখে প্রিন্সিপালের কালো মুখ বেগুনি হয়, ড. আফাজ আহমদ এমএসসি, পিএইচডি, ই পি এস ই এস হওয়ার চেষ্টা করতে করতে স্যার বলে, ‘হি ইজ প্রফেসর হুদা।’
কিন্তু ড. আফাজ আহমদ এমএসসি, পিএইচডি নিজের ভুল সংশোধন না করে পারে না, ‘সরি হি ইজ নট এ প্রফেসর। এ লেকচারার ইন কেমিস্ট্রি। 
‘শাট আপ।’ 
এবার প্রিন্সিপাল থামে।
তাকে এবং আবদুস সাত্তার মৃধাকে নিয়ে মিলিটারি জিপে তোলার আগে জাঁদরেল কর্নেল না ব্রিগেডিয়ার প্রিন্সিপালকে কড়া গলায় বলে, সেনাবাহিনীকে নিয়ে মজা করে শায়েরি করা খুব বড়ো অপরাধ। 🔒ব্যাখ্যা এবার তাকে ছেড়ে দেওয়া হলো, তবে কড়া ওয়াচে রাখা হবে। উর্দুর প্রফেসর আকবর সাজিদের দোহাই পেড়ে প্রিন্সিপালের সুবিধা হয় না। নুরুল উদ্বিগ্ন হয়, সাজিদ সাহেব যদি পালিয়ে না থাকে তো তার কপালে যে কী আছে তা জানে এক আল্লা আর জানে এই মিলিটারি।
তাদের দুজনের চোখ বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, জিপ চলছিল এঁকেবেঁকে। মস্ত উঁচু একটা ঘরে তাদের এনে ফেলা হলো। চোখ খুলে দিলে সে আবদুস সাত্তার মৃধাকে দেখতে পায় না। জায়গাটাও একেবারে অচেনা। একটা ডেক-চেয়ারে সে যে কতক্ষণ বসে থাকল তার কোনো হিসাব নেই। তার সামনে একটা চেয়ারে এসে বসল এক মিলিটারি। তাকে ইংরেজিতে নানান প্রশ্ন করে, সে জবাব দেয়। লোকটা চলে গেলে তাকে অন্য ঘরে নিয়ে ফের অন্য একটা লোক এসে তাকে প্রশ্ন করে এবং সে জবাব দেয়। প্রশ্নগুলো প্রায় একইরকম এবং তার উত্তরেরও হেরফের হয় না। যেমন, কিছুদিন আগে তাদের কলেজে কয়েকটা লোহার আলমারি কেনা হয়েছে। ওগুলো বয়ে নিয়ে এসেছিল কারা?
সে জবাব দেয়, ঠিক। অফিসের জন্যে তিনটে, বোটানি হিস্ট্রি জিওগ্রাফি ডিপার্টমেন্টের জন্যে দুটো করে এবং ইংরেজির জন্যে একটা, সর্বমোট দশটি আলমারি কলেজে নিয়ে আসা হয়েছে। 
এত কথা বলার দরকার নাই তার। ওই আলমারিগুলো নিয়ে আসা হয় কয়েকটা ঠেলাগাড়ি করে। ঠেলাগাড়িওয়ালাদের তো সে ভালো করেই চেনে। 
নুরুল হুদা জবাব দেয়, তাদের সে চিনবে কোত্থেকে? তারা হলো কুলি, সে একজন লেকচারার। 
তাহলে সে তাদের সঙ্গে এত কথা বলছিল কেন? 
প্রিন্সিপালের আদেশে সে আলমারিগুলোর স্টিলের পাতের ঘনত্ব,দেরাজের সংখ্যা ও আকার, তালাচাবির মান, রঙের মান প্রভৃতি পরীক্ষা করে দেখছিল, তার দায়িত্ব ছিল-। 
মিলিটারি শান্ত গলায় তথ্য সরবরাহ করার ভঙ্গিতে বলে, মিসক্রিয়েন্টরা কলেজে ঢুকেছিল কুলির বেশে। এটা তার চেয়ে আর ভালো জানে কে? তারা আজ ধরা পড়ে নুরুল হুদার নাম বলেছে। তাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ নিয়মিত, সে গ্যাঙের একজন সক্রিয় সদস্য। 
‘আমার নাম? সত্যি বলেছ? আমার নাম বলেছ?’ 🔒ব্যাখ্যা নুরুল হুদার হঠাৎ চিৎকারে মিলিটারি বিরক্ত হয় না, বরং উৎসাহ পায়। উৎসাহিত মিলিটারি ফের বলে, কুলিরা ছিল ছদ্মবেশী মিসক্রিয়েন্ট। তারা কলেজের টিচারদের মধ্যে নুরুল হুদার নামই বলেছে।
নুরুল হুদা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। 🔒ব্যাখ্যা তারা কি তাকে চেনে? কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে আলমারি সাজিয়ে রাখার সময় এক কুলি দাঁড়িয়েছিল তার গা ঘেঁষে! তখন তো ঘোরতর বর্ষাকাল, ঢাকায় এবার বৃষ্টিও হয়েছে খুব। রাতদিন এই বৃষ্টি নিয়ে সে কি যেন বলেছিল, তাতে কুলিটা বিড়বিড় করে ওঠে, ‘বর্ষাকালেই তো জুৎ’। কথাটা দুবার বলেছিল। এর মানে কী? স্টাফরুমে কে একজন একদিন না দুদিন ফিসফিস করছিল, বাংলার বর্ষা তো শালারা জানে না। রাশিয়ায় ছিল জেনারেল উইনটার, আমাদের জেনারেল মনসুন। 🔒ব্যাখ্যা -ওই ছদ্মবেশী ছেলেটা কি এই কথাই বুঝিয়েছিল? তার ওপর তাদের এত আস্থা?-উৎসাহে নুরুল হুদা এদিকওদিক তাকায়। তার মৌনতা মিলিটারিকে আরেকটু নিশ্চিত করে। 
কিছুক্ষণ পর, কতক্ষণ পর সে বুঝতে পারে না, মিলিটারি তাকে ফের একই প্রশ্ন করে জবাব না পেয়ে প্রবল বেগে দুটো ঘুষি লাগায় তার মুখে। প্রথম ঘুষিতে সে কাত হয়, দ্বিতীয় ঘুষিতে পড়ে যায় মেঝেতে। মেঝে থেকে তুলে তাকে মিলিটারি ফের জিজ্ঞেস করে, ওদের আস্তানা কোথায় সে খবর তার তো ভালোভাবেই জানা আছে। সে জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ’! 
ওই ঠিকানাটা বলে দিলেই তো তাকে সসম্মানে ছেড়ে দেওয়া হবে এই নিশ্চয়তা দিয়ে তাকে পাউরুটি ও দুধ খাওয়ানো হয়। তাঁকে ভাবতে সময় দিয়ে মিলিটারি চলে যায়। কিছুক্ষণ পর, কতক্ষণ সে জানে না, মিলিটারি ফিরে এসে ফের বলে, মিসক্রিয়েন্টদের ঠিকানা তো তার জানা আছে। সে ফের জবাব দেয়, হ্যাঁ’। কিন্তু পরের প্রশ্নের জবাব না পেয়ে মিলিটারি তাকে নিয়ে যায় অন্য একটি ঘরে। তার বেঁটেখাটো শরীরটাকে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো ছাদে-লাগানো একটা আংটার সঙ্গে। তার পাছায় চাবুকের বাড়ি পড়ে সপাৎ সপাৎ করে। তবে বাড়িগুলো বিরতিহীন পড়তে থাকায় কিচুক্ষণের মধ্যে সেগুলো নুরুল হুদার কাছে মনে হয় স্রেফ উৎপাত বলে। 🔒ব্যাখ্যা মনে হচ্ছে যেন বৃষ্টি পড়ছে মিন্টুর রেইনকোটের ওপর। 🔒ব্যাখ্যা রেইনকোটটা এরা খুলে ফেলেছে, কোথায় রাখল কে জানে। কিন্তু তার ওম তার শরীরে এখনো লেগেই রয়েছে। 🔒ব্যাখ্যা বৃষ্টির মতো চাবুকের বাড়ি পড়ে তার রেইনকোটের মতো চামড়ায় আর সে অবিরাম বলেই চলে, মিসক্রিয়েন্টদের ঠিকানা তার জানা আছে। শুধু তার শালার নয়, তার ঠিকানা জানার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নাই, সে ছদ্মবেশী কুলিদের আস্তানাও চেনে। তারাও তাকে চেনে এবং তার ওপর তাদের আস্থাও কম নয়। 🔒ব্যাখ্যা তাদের সঙ্গে তার আঁতাতের অভিযোগ ও তাদের সঙ্গে তার আঁতাত রাখার উত্তেজনায় নুরুল হুদার ঝুলন্ত শরীর এতটাই কাঁপে যে চাবুকের বাড়ির দিকে তার আর মনোযোগ দেওয়া হয়ে ওঠে না। 🔒ব্যাখ্যা  
   

পাঠ-পরিচিতি
রেইনকোট' গল্পটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে। পরে এটি লেখকের সর্বশেষ গল্পগ্রন্থ ‘জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল’ (১৯৯৭) গ্রন্থে সংকলিত হয়। এ গল্পের পাঠ গ্রহণ করা হয়েছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচনাসমগ্র ১ থেকে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ে গল্পটি রচিত। মুক্তিযুদ্ধের তখন শেষ পর্যায়। ঢাকায় তখন মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ শুরু হয়েছে। তারই একটি ঘটনা এ গল্পের বিষয়; যেখানে ঢাকা কলেজের সামনে গেরিলা আক্রমণের ফলে বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কলেজের শিক্ষকদের তলব করে এবং তাদের মধ্য থেকে নুরুল হুদা ও আবদুস সাত্তার মৃধাকে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধান পাওয়ার চেষ্টা করে। নুরুল হুদার জবানিতে গল্পের অধিকাংশ ঘটনা বিবৃত হয়েছে। বিবৃত হয়েছে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞের মধ্যে ঢাকা শহরের আতঙ্কগ্রস্ত জীবনের চিত্র। গেরিলা আক্রমণের ঘটনা ঘটে যে রাতে, তার পরদিন সকালে ছিল বৃষ্টি । তলব পেয়ে সেই বৃষ্টির মধ্যে নুরুল হুদাকে কলেজে যেতে যে রেইনকোটটি পরতে হয় সেটি ছিল তার শ্যালক মুক্তিযোদ্ধা মিন্টুর। গল্পে এই রেইনকোটের প্রতীকী তাৎপর্য অসাধারণ । মুক্তিযোদ্ধা শ্যালকের রেইনকোট গায়ে দিয়ে সাধারণ ভীতু প্রকৃতির নুরুল হুদার মধ্যে সঞ্চারিত হয় যে উষ্ণতা, সাহস ও দেশপ্রেম— তারই ব্যঞ্জনাময় প্রকাশ ঘটেছে এ গল্পে ।                                

উত্তর : ‘রেইনকোট’ গল্পে আসমা গল্পকথক নুরুল হুদার স্ত্রী।

উত্তর : ‘রেইনকোট’ গল্পে পিয়নের নাম ইসহাক মিয়া।

উত্তর : মুক্তিযোদ্ধা শ্যালক মিন্টুর জন্য নুরুলহুদাকে এক্সট্রা তটস্থ থাকতে হয়।

উত্তর : অফিসের জন্য দশটি আলমারি কেনা হয়েছিল।

উত্তর : ‘রেইনকোট’ গল্পে উল্লিখিত ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপালের নাম ড. আফাজ আহমদ।

উত্তর : নুরুল হুদা।    

উত্তর : উর্দুর প্রফেসরের নাম আকবর সাজিদ।   

উত্তর : ‘রেইনকোট’ গল্পটি ‘জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল’ গল্পগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত।   

উত্তর : দোকানি ছেলেটা বাচাল টাইপের।   

উত্তর : তটস্থ থাকতে হয়।    

উত্তর : প্রিন্সিপাল আফাজ আহমদ হিন্দুস্তান ও মুক্তিযোদ্ধাদের পতন কামনা করায় তার কামরায় আজকাল সহজে কেউ ঘেঁষে না।
ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল আফাজ আহমদ পাকিস্তানের একনিষ্ঠ সমর্থক। তিনি পাক মিলিটারির সকল কাজে সমর্থনও সহযোগিতা করেন।  মুক্তিযোদ্ধা গেরিলারা যাতে সফল না হয় এবং পাকিস্তান যাতে জয় লাভ করে এজন্য সর্বদা তিনি দোয়া-দরুদ পড়েন। তার কামরায় কোনো শিক্ষক গেলেই তিনি হিন্তুস্তান ও মিসক্রিয়ান্ট তথা গেরিলা যোদ্ধাদের অবশ্যম্ভ্যাবী পতনের বাণী শোনান। তাই আজকাল ওই ঘরে সহজে কেউ জেতে চায় না। 

উত্তর : ১৯৭১ সালের  ২৫মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় যে ভয়াবহ ধ্বংসজ্ঞ ও হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেছিল, ক্রাক-ডাউনের রাত বলতে তাকেই বোঝানো হয়েছে।
১৯৭১ সালে অপ্রত্যাশিতহভাবে পাকিস্তানি সেনারা  নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা ২৫ মার্চের দিবাগত রাতে ঢাকায় ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের রাতটিকেই ‘ক্রাকডাউন রাত’ বলা হয়।

উত্তর : বিরতিহীনভাবে পড়তে থাকা চাবুকের বাড়িকে নুরুল হুদার কাছে মনে হয় যেন বৃষ্টি পড়ছে রেইনকোটের ওপর।
মুক্তিযোদ্ধা শ্যালক মিন্টুর রেইনকোটটি পরার পর থেকেই ভীতু প্রকৃতির নুরুল হুদার মাঝে সঞ্চারিত হয় সাহস ও দেশপ্রেমের এক বিচিত্র অনুভূতি। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নুরুল হুদার সংযোগ থাকার অভিযোগ থাকায় তাকে চাবুক দিয়ে পিটিয়ে তথ্য বের করার চেষ্টা চালায় পাকিস্তান সেনারা। কিন্তু রেইনকোটটির কারনে তার মাঝে যে প্রেরণার সৃষ্টি হয়েছিল,  তা যেন তার চাবুকের আঘাতকে ভুলিয়ে দিয়েছিল।  নুরুল হুদার কাছে তাই চাবুকের আঘাতের ব্যাপারটি রেইনকোটের ওপর বৃষ্টি পড়ার মতোই স্বাভাবিক লাগছিল।

উত্তর : ঠাণ্ডা হাওয়ার ধাক্কা রেইনকোটের তাপে গরম হয়ে ওঠার কারণ নুরুল হুদার ভেতরের মুক্তিযোদ্ধা শ্যালকের সাহস ও উষ্ণতা সঞ্চারিত হওয়া।
ঢাকা কলেজের সামান্য বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণের ঘটনায় পাক মিলিটারিরা শিক্ষক নুরুল হুদাকে তলব করে। প্রবল বৃষ্টির দিনে তিনি শ্যালক মুক্তিযোদ্ধা মিন্টুর রেইনকোট গায়ে জড়িয়ে বাইরে বের হন। এ রেইনকোটটি একজন মুক্তিযোদ্ধার হওয়ায় এটির মালিকের সাহস তার মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে। তাই যে মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনকে পাক মিলিটারিরা গুলি করে ফেলে দিয়েছিল  সেখানে উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নুরুল হুদার  মধ্যে বিশেষ ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। মুক্তিযোদ্ধা শ্যালকের রেইনকোটের  ভেতরে তিনি আলাদা তেজ অনুভব করেন। এ বিষয়টি বোঝাতে বাইরের ঠাণ্ডা হাওয়ার ধাক্কা রেইনকোটের তাপে গরম হয়ে ওঠার কথা বলেন।

উত্তর : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রচণ্ড শীত রুশ বাহিনীর পক্ষে যেমন অনুকূল হয়েছিল তেমনই আমাদের দেশে বর্ষা মৌসুমও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনুকূল ছিল-এ বিষয়টি বোঝাতেই প্রশ্নোক্ত উক্তিটি করা হয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময় হিটলার বাহিনী প্রচণ্ড শীতের কারণে রুশ বাহিনীর হাতে পর্যদস্ত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রবল বর্ষার তেমনই বিপদজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। উক্তিটির মাধ্যমে সেই বিষয়টির কথাই বলা হয়েছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের ছেলেরা বর্ষার সঙ্গে পরিচিত থাকলেও পাকিস্তানি বাহিনীর তা ছিল না। কুলির ছন্দবেশ কলেজে আলমারি দিতে এসে এক গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা বলেছিলেন ‘বর্ষাকালেই তো জুৎ’। নুরূল হুদার মনে হয় এ কথার মধ্য দিয়ে ছেলেটি যেন আলোচ্য কথাটিই বলতে চেয়েছে।

উত্তর : আকাশে মেঘ দেখে আন্দাজ করা যায় বৃষ্টি কদিন থাকবে।    আবার প্রবাদ-প্রবচন মতে সপ্তাহের কোন দিন থেকে শুরু হলো তা অনুসরণ করেও বলা যায় বৃষ্টি কদিন থাকবে।    শনিবার শুরু হলে সাত দিন আর মঙ্গলবার শুরু হলে তিন দিন।    সেই বিচারে বলা হয়েছে যেহেতু মঙ্গলবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে সুতরাং আল্লা দিলে তিন দিন তো বৃষ্টি থাকবেই।  

উত্তর : উল্লিখিত উক্তিটি দ্বারা বাংলায় বৃষ্টি বর্ষণের প্রবলতাকে বোঝানো হয়েছে।   
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বর্ষা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।    খনার বচন অনুযায়ী বৃষ্টি কিছু নিয়ম মেনে চলে।    যেমন- শনিবারে যদি বৃষ্টি শুরু হয়, তবে সাত দিন স্থায়ী হয়।    আবার মঙ্গলবারে শুরু হলে তা তিন দিন স্থায়ী হয় এবং এই দু-দিন ছাড়া সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে বৃষ্টি শুরু হলে তা একদিন স্থায়ী হয়।    গল্পে মঙ্গলবারে বৃষ্টি শুরু  হওয়ায় নুরুল হুদা তা তিন দিন স্থায়ী হবে বলে স্থির সিদ্ধান্ত নেন এবং পাকিস্তানি হানাদারেরা এই বৃষ্টির প্রবলতার কারণে বাইরে বের হবে না বলে মনে করেন।    উক্তিটি দ্বারা বাংলায় বৃষ্টি বর্ষণের এ প্রবলতাকে বোঝানো হয়েছে।   

উত্তর : মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী সন্দেহে এদেশেরই কিছু সাধারণ মানুষ নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়েছেন।    পাকিস্তানি বাহিনীর তাণ্ডব চলছে দিন রাত।    কখনো আকাশ বিদীর্ণ চিৎকার।    কখনো বা নিশ্চুপ থেকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা, কখনো বা অজানা মৃত্যু যন্ত্রণাকে চোখের সামনে দেখা।    কিন্তু পাল্টা জবাব দিতে থেমে নেই এদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারাও।    প্রতিদিনই দিনে রাতে গুলির ফুটফাট আওয়াজ শোনা যায়।    কখনো মিলিটারির, কখনো মুক্তিযোদ্ধার।    অস্ত্রের খেলা রাতেই বেশি চলে।    তিন দিন বৃষ্টি থাকলে হয়তো এ তাণ্ডবলীলা একটু বিরতি নেবে, বন্দুক বারুদও একটু জিরিয়ে নেবে।  

উত্তর : নুরুল হুদা মিলিটারের ভয়ে সুরা পড়তে পড়তে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।   
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচিত ‘রেইনকোট’ গল্পের অপ্রধান চরিত্র নুরুল হুদার শ্যালক মিন্টু।  দেশের প্রতি গভীর  ভালোবাসা থেকে সে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় এবং দুলাভাই নুরুল হুদার বাসায় আশ্রয় নেয়।  এজন্য নুরুল হুদা প্রায়ই আতঙ্কগ্রস্ত থাকেন মিলিটারিরা না-জানি কখন মিন্টুর খোঁজে তার বাসায় আসে।  নুরুল হুদা এমনিতেই অনেক ভীতু উপরন্তু মুক্তিযোদ্ধা শ্যালককে নিয়ে তিনি আরও বেশি চিন্তিত।    একদিন বর্ষার সময় কলেজের পিওন দরজায় কড়াঘাত করলে তিনি মিলিটারির ভয়ে সুরা পড়তে পড়তে দরজার দিকে এগিয়ে যান।   

উত্তর : আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচিত ‘রেইনকোট’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র নুরুল হুদা যুদ্ধের সময় নিজেকে মুসলিম হিসেবে প্রমাণ করতে অনেক সুরা মুখস্থ করেন।   
‘রেইনকোট’ গল্পে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে পরিচালনা করার নীল নকশা ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসররা সেদিন বেছে সংখ্যালঘু হিন্দুদের হত্যা করছিল।  এমনকি মিলিটারি চেকপোস্টে যাত্রীদের গোপন জায়গা তল্লাশি করে হিন্দুদের হত্যা করা হতো।    মুসলিমদেরকেও কালেমা, সুরা পাঠ করিয়ে রেহাই দিত।    নুরুল হুদা পাকবাহিনীর এই সাম্প্রদায়িক ইস্যু থেকে বাঁচতে অনেক সুরা মুখস্থ করেন।   

ক) প্রিন্সিপালের অফিস
খ) প্রিন্সিপালের কোয়ার্টার
গ) ফুটবল মাঠ
ঘ) জিমন্যাশিয়ন

উত্তর : ঘ
_

ক) আব্দুল সাত্তার
খ) আকবর সাজিদ
গ) আফাজ আহমদ
ঘ) ইসহাক মিয়া

উত্তর : ঘ
_

ক) গেরিলা
খ) মিসক্রিয়ান্ট
গ) জেনারেল
ঘ) শহিদ মিনার

উত্তর : ঘ
_

ক) কলেজ কম্পাউন্ড
খ) জিমনেশিয়াম
গ) স্মৃতিসৌধ
ঘ) শহিদ মিনার

উত্তর : ঘ
_

ক) সম্ভাবনা
খ) ব্যাঙ্গ
গ) সন্তুষ্টি
ঘ) আশা

উত্তর : খ
_

Score Board

_









_

_









_

অনুচ্ছেদটিতে ‘রেইনকোট’ গল্পের কোন ভাবের প্রতিফলন ঘটেছে ?









_

_









_

_









_
Score Board

উত্তর :
ক) উর্দুর প্রফেসরের নাম আকবর সাজিদ।    

খ) “যেন বৃষ্টি পড়ছে মিন্টুর রেইনকোটের ওপর” কথাটি নুরুল হুদা পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের সময় নিজের অনুভূতিহীনতার কথা বোঝাতে  বলেছেন।    

কলেজ শিক্ষক নুরুল হুদাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ডেকে নিয়ে যায়।    প্রচÐ বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে নুরুল হুদা শ্যালক মুক্তিযোদ্ধা মিন্টুর রেইনকোটটি পরে সেখানে যান।    সেখানে যাওয়ার পর তার কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য জানতে চাওয়া হয়।    তার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের আতীত রয়েছে একথা তিনি অস্বীকার করলেও জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে তাকে একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় ছাদে লাগানো একটা আংটার সঙ্গে।    পাকিস্তানি সেনার অবিরাম পড়তে থাকা চাবুকের সপাৎ সপাৎ বাড়ি তার কাছে ¯্রফে উৎপাত বলে মনে হয়।    তার কাছে মনে হয়ে মিন্টুর রেইনকোটের ওপর যেন অবিরাম ধারায় বৃষ্টি পড়ছে।    কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তার যোগাযোগ রয়েছে এ খবর শুনে তিনি অভিভূত হন এবং ভেতরে ভেতরে যোদ্ধা হয়ে ওঠেন।    

গ) উদ্দীপক ও ‘রেইনকোট’ গল্পে পাকবাহিনীর নির্মম নির্যাতন প্রতিফলিত হয়েছে।    

১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ মধ্যরাত থেকে শুরু করে ১৬ ই ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানি সেনারা এদেশের নিরীহ মানুষের ওপর নির্মম  নির্যাতন চালিয়েছে।    তারা এদেশের নিরীহ, নিরস্ত্র ঘুমন্ত মানুষের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের হত্যঅ করেছে।    

উদ্দীপকে কলিমদ্দি দফাদারের সবিনয় অনুরোধ উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে সাধারণ মানুষকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে, পাকিস্তানি সেনাদের সেই নির্মমতার একটি পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে।    কলিমদ্দি দফাদারের বাল্যকালের পাতানো বন্ধুর ছেলেকে তার চোখের সামনে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা।    তাদের এই নির্মমতা ‘রেইনকোট’ গল্পে প্রতিফলিত হয়েছে।    এ গল্পে কলেজ শিক্ষক নুরূল হুদার জবানীতে পাকিস্তানি সেনাদের নিষ্ঠুরতার দিকটি উঠে এসেছে।    মুক্তিযোদ্ধাদের খবর জানতে নুরূল হুদা ও আবদুস সাত্তার মৃধাকে ডেকে নিয়ে তারা নির্যাতন চালিয়েছে।    আজান দেওয়া অবস্থায় মসজিদের ছাদে মুয়জ্জিনকে হত্যা করেছে, ফারারিং স্কোয়াডে নিয়ে গিয়ে তারা সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে।    নারীদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে নির্যাতন ও হত্যা করেছে।    এভাবে উদ্দীপক ও ‘রেইনকোট’ গল্পে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের দিকটি ফুটে উঠেছে।    

ঘ) “উদ্দীপকটি ‘রেইনকোট’ গল্পের আংশিক প্রতিনিধিত্ব করে।   ” মন্তব্যটি যথার্থ।  

শোষকরা চিরকালই দুর্বল অসহায়দের ওপর কতৃত্ব বজায় রাখতে নির্মম নির্যাতন চালায়।     ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এদেশের  সাধারণ মানুষের ওপর নির্মম নির্যাতন ও অত্যাচার চালায়।    তাদের নির্মমতা থেকে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ কেউ রেহাই পাইনি।    তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে এদেশের সর্বস্তরের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাড়ায়।    

উদ্দীপকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে ষোলো বছরের এক যুবককে গুলি করে হত্যা করার বিষয়টি তুলে ধরার মধ্যে পাকিস্তানি হানাদাররা যে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে সেই দিকটি প্রতিফলিত হয়েছে।    এই বিষয়টি ছাড়াও ‘রেইনকোট’ গল্পে আরও বিষয় সম্পর্কে বর্ননা করা হয়েছে।    সেই ঘটনাগুলো আরও মর্মান্তিক।    সেখানে মসজিদের মুয়জ্জিনকে আজান দিতে হত্যা করেছে।    নুরূল হুদাকে নির্মম নির্যাতন করে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য বের করার চেষ্টা করা হয়েছে।    

‘রেইনকোট’ গল্পে মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ঢাকার যুদ্ধাবস্থা, এদেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের বর্বর নিপীড়ন-নির্যাতন হত্যাজ্ঞের দিক প্রতিফলিত হয়েছে।    এতে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে এদেশের সর্বস্তরের মানুষের রুখে দাঁড়ানোর বিষয়টি রয়েছে যা উদ্দীপকে নেই।    গল্পে ছাত্র, শিক্ষক, কুলি, মজুর সবাই  শত্রæনিধনের প্রতিজ্ঞা নিয়ে ঐক্যবদ্ধ ও তৎপর।    সেখানে আত্মরক্ষার জন্য কিছু লোকের পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের সঙ্গে সখ্য গড়ার বিষয়ও প্রতিফলিত হয়েছে।    এসব বিষয় উদ্দীপকে অনুপস্থিত।    তাই বলা যায়, প্রশ্নোক্ত মন্তব্যটি যথার্থ।