মানব কল্যাণ
আবুল ফজল
প্রাবন্ধিক-পরিচিতি:
নাম : আবুল ফজল
জন্ম : পহেলা জুলাই, ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দ।
জন্মস্থান : সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম।
পিতার নাম : ফজলুর রহমান।
শিক্ষাজীবন : চট্টগ্রাম ও ঢাকায়।
পেশা : স্কুল শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন।
সাহিত্যকর্ম :
উপন্যাস : চৌচির, রাঙা প্রভাত।
গল্পগ্রন্থ : মাটির পৃথিবী, মৃতের আত্মহত্যা।
প্রবন্ধ : সাহিত্য সংস্কৃতি সাধনা, সাহিত্য সংস্কৃতি ও জীবন, সমাজ সাহিত্য ও রাষ্ট্র, মানবতন্ত্র, একুশ মানে মাথা নত না করা।
দিনলিপি : রেখাচিত্র, দুর্দিনের দিনলিপি ।
পুরস্কার ও সম্মাননা : বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
মৃত্যু : ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ৪ মে, চট্টগ্রামে।
মানব-কল্যাণ- এ শিরোনাম আমার দেওয়া নয়। আমাদের প্রচলিত ধারণা আর চলতি কথায় মানব-কল্যাণ কথাটা অনেকখানি সস্তা আর মামুলি অর্থেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। 🔒ব্যাখ্যা
একমুষ্টি ভিক্ষা দেওয়াকেও আমরা মানব-কল্যাণ মনে করে থাকি। মনুষ্যত্ববোধ আর মানব-মর্যাদাকে এতে যে ক্ষুণ্ণ করা হয় 🔒ব্যাখ্যা তা সাধারণত উপলব্ধি করা হয় না। 🔒ব্যাখ্যা
ইসলামের নবি বলেছেন, ওপরের হাত সব সময় নিচের হাত থেকে শ্রেষ্ঠ। 🔒ব্যাখ্যা নিচের হাত মানে যে মানুষ হাত পেতে গ্রহণ করে, ওপরের হাত মানে দাতা- যে হাত তুলে ওপর থেকে অনুগ্রহ বর্ষণ করে। 🔒ব্যাখ্যা দান বা ভিক্ষা গ্রহণকারীর দীনতা তার সর্ব অবয়বে কীভাবে প্রতিফলিত হয় তার বীভৎস দৃশ্য কার না নজরে পড়েছে?
মনুষ্যত্ব আর মানব-মর্যাদার দিক থেকে অনুগ্রহকারী আর অনুগৃহীতের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত। 🔒ব্যাখ্যা এ ব্যক্তির বেলায় যেমন সত্য, তেমনি দেশ আর রাষ্ট্রের বেলায় বরং অধিকতর সত্য। 🔒ব্যাখ্যা কারণ, রাষ্ট্র জাতির যৌথ জীবন আর যৌথ চেতনারই প্রতীক। 🔒ব্যাখ্যা
রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু প্রশাসন চালানোই নয়, জাতিকে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন করে তোলাও রাষ্ট্রের এক বৃহত্তর দায়িত্ব। যে রাষ্ট্র হাতপাতা আর চাটুকারিতাকে দেয় প্রশ্রয়, 🔒ব্যাখ্যা সে রাষ্ট্র কিছুতেই আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক সৃষ্টি করতে পারে না।
তাই মানব-কল্যাণ অর্থে আমি দয়া বা করুণার বশবর্তী হয়ে দান-খয়রাতকে মনে করি না। মনুষ্যত্বের অবমাননা যে ক্রিয়াকর্মের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি তাকে কিছুতেই মানব-কল্যাণ নামে অভিহিত করা যায় না। 🔒ব্যাখ্যা মানব-কল্যাণের উৎস মানুষের মর্যাদাবোধ বৃদ্ধি আর মানবিক চেতনা বিকাশের মধ্যেই নিহিত। 🔒ব্যাখ্যা একদিন এক ব্যক্তি ইসলামের নবীর কাছে ভিক্ষা চাইতে এসেছিলো। নবী তাকে একখানা কুড়াল কিনে দিয়ে বলেছিলেন, 🔒ব্যাখ্যা এটি দিয়ে তুমি বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা রোজগার করো গে। এভাবে তিনি লোকটিকে শুধু স্বাবলম্বনের পথ দেখান নি, সে সঙ্গে দেখিয়ে দিয়েছিলেন মর্যাদাবান হওয়ার, মর্যাদার সাথে জীবযাপনের উপায়ও।
মানুষকে মানুষ হিসেবে এবং মানবিক-বৃত্তির বিকাশের পথেই বেড়ে উঠতে হবে আর তার যথাযথ ক্ষেত্র রচনাই মানব-কল্যাণের প্রাথমিক সোপান। 🔒ব্যাখ্যা সে সোপান রচনাই সমাজ আর রাষ্ট্রের দায়িত্ব। 🔒ব্যাখ্যা সমাজের ক্ষুদ্রতম অঙ্গ বা ইউনিট পরিবার– সে পরিবারকেও পালন করতে হয় এ দায়িত্ব। কারণ, মানুষের ভবিষ্যৎ জীবনের সূচনা সেখান থেকেই। ধীরে ধীরে ব্যাপকতর পরিধিতে যখন মানুষের বিচরণ হয় শুরু, তখন সে পরিধিতে যে সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার সংযোগ ঘটে– তা শিক্ষা কিংবা জীবিকা সংক্রান্ত যা হোক না তখন সে দায়িত্ব ঐ সব প্রতিষ্ঠানের ওপরও বর্তায়। তবে তা অনেকখানি নির্ভর করে অনুকূল পরিবেশ ও ক্ষেত্র গড়ে তোলার ওপর। 🔒ব্যাখ্যা
মানব-কল্যাণ স্বয়ম্ভূ ,বিচ্ছিন্ন ,সম্পর্ক-রহিত হতে পারে না। প্রতিটি মানুষ যেমন সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত, তেমনি তার কল্যাণও সামগ্রিকভাবে সমাজের ভালো-মন্দের সঙ্গে সংযুক্ত। উপলব্ধি ছাড়া মানব-কল্যাণ স্রেফ দান-খয়রাত আর কাঙালি ভোজনের মতো মানব-মর্যাদার অবমাননাকর এক পদ্ধতি না হয়ে যায় না, 🔒ব্যাখ্যা যা আমাদের দেশ আর সমাজে হয়েছে। এসবকে বাহবা দেওয়ার এবং এ সব করে বাহবা কুড়োবার লোকেরও অভাব নেই দেশে।
আসল কথা, মানুষের মনুষ্যত্বকে বাদ দিয়ে স্রেফ তার জৈব অস্তিত্বের প্রতি সহানুভূতিশীল এ ধরনের মানব-কল্যাণ কিছুমাত্র ফলপ্রসূ হতে পারে না। 🔒ব্যাখ্যা এ হেন মানব-কল্যাণের কুৎসিত ছবি দেখার জন্য দূরদূরান্তে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, 🔒ব্যাখ্যা আমাদের আশে পাশে, চারদিকে তাকিয়ে দেখলেই তা দেখা যায়।
বর্তমানে মানব-কল্যাণ অর্থে আমরা যা বুঝি তার প্রধানতম অন্তরায় রাষ্ট্র, জাতি, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীগত চেতনা–যা মানুষকে মেলায় না, করে বিভক্ত। বিভক্তিকরণের মনোভাব নিয়ে কারো কল্যাণ করা যায় না। 🔒ব্যাখ্যা করা যায় একমাত্র সমতা আর সহযোগ সহযোগিতার পথে।
সত্যিকার মানব কল্যাণ মহৎ চিন্তা-ভাবনারই ফসল। 🔒ব্যাখ্যা বাংলাদেশের মহৎ প্রতিভারা সবাই মানবিক চিন্তা আর আদর্শের উত্তরাধিকার রেখে গেছেন। দুঃখের বিষয়, 🔒ব্যাখ্যা সে উত্তরাধিকারকে আমরা জীবনে প্রয়োগ করতে পারিনি।
বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস থেকে লালন প্রমুখ কবি এবং অপেক্ষাকৃত আধুনিককালে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল সবাইতো মানবিক চেতনার উদাত্ত কণ্ঠস্বর। বঙ্কিমচন্দ্রের অবিস্মরণীয় সাহিত্যিক উক্তি 🔒ব্যাখ্যা : ‘তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?’ এক গভীর মূল্যবোধেরই উৎসারণ। 🔒ব্যাখ্যা
এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিম্নলিখিত উক্তিটিও স্মরণীয় : ‘Relationship is the fundamental truth of the world of appearence’ কবি এ উক্তি করেছিলেন তার হিবার্ট বক্তৃতামালায়। অন্তর জগতের বাইরে যে জগৎকে আমরা অহরহ দেখতে পাই তার মৌলিক সত্য পারস্পরিক সংযোগ-সহযোগিতা, কবি যাকে relationship বলেছেন। সে সংযোগ বা সম্পর্কের অভাব ঘটলে মানব-কল্যাণ কথাটা স্রেফ ভিক্ষা দেওয়া নেওয়ার সম্পর্কে পরিণত হয়।
মানব-কল্যাণ অলৌকিক কিছু নয়–এ এক জাগতিক মানবধর্ম। 🔒ব্যাখ্যা তাই এর সাথে মানব-মর্যাদার তথা human dignity-র সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। আজ পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখলে কী দেখতে পাই? দেখতে পাই দুঃস্থ, অবহেলিত, বাস্তুহারা, স্বদেশ-বিতাড়িত মানুষের সংখ্যা দিন দিনই বেড়ে চলেছে। সে সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে রিলিফ, রিহেবিলিটেশন ইত্যাদি শব্দের ব্যাপক প্রয়োগ। রেডক্রস ইত্যাদি সেবাধর্মী সংস্থার সংখ্যাবৃদ্ধিই কি প্রমাণ করে না মানব-কল্যাণ কথাটা স্রেফ মানব-অপমানে পরিণত হয়েছে? 🔒ব্যাখ্যা মানুষের স্বাভাবিক অধিকার আর মর্যাদার স্বীকৃতি আর প্রতিষ্ঠা ছাড়া মানব-কল্যাণ মানব-অপমানে পরিণত না হয়ে পারে না। 🔒ব্যাখ্যা
কালের বিবর্তনে আমরা এখন আর tribe বা গোষ্ঠীবদ্ধ জীব নই–বৃহত্তর মানবতার অংশ। তাই Go of humanity-কে বিচ্ছিন্ন,বিক্ষিপ্ত কিংবা খণ্ডিতভাবে দেখা বা নেওয়া যায় না। তেমনি নেওয়া যায় না তার কল্যাণকর্মকেও খণ্ডিত করে। দেখতে মানুষও অন্য একটা প্রাণী মাত্র, কিন্তু ভেতরে মানুষের মধ্যে রয়েছে এক অসীম ও অনন্ত সম্ভাবনার বীজ। যে সম্ভাবনার ফুরণ-ফুটনের সুযোগ দেওয়া, ক্ষেত্র রচনা আর তাতে সাহায্য করাই শ্রেষ্ঠতম মানব-কল্যাণ। 🔒ব্যাখ্যা সেটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য কিংবা কোনো রকম অপমান-অবমাননার পথে হতে পারে না। হালে যে দর্শনকে অস্তিত্ববাদ নামে অভিহিত করা হয়, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ঢxistentialism তারও মূল কথা ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দান।
বল প্রয়োগ কিংবা সামরিক শাসন দিয়ে মানুষকে তাবেদার কিংবা চাটুকার বানাতে পারা যায় কিন্তু প্রতিষ্ঠা করা যায় না মানব মর্যাদার আসনে। সব কর্মের সাথে শুধু যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকে তা নয়,তার সামাজিক পরিণতি তথা social consequence-ও অবিচ্ছিন্ন। যেহেতু সব মানুষই সমাজের অঙ্গ, তাই সব রকম কল্যাণ-কর্মেরও রয়েছে সামাজিক পরিণতি। এ সত্যটা অনেক সময় ভুলে থাকা হয়। 🔒ব্যাখ্যা বিশেষত যখন দৃষ্টি থাকে ঊর্ধ্ব দিকে তথা পরলোকের পানে। 🔒ব্যাখ্যা
স্রেফ সদিচ্ছার দ্বারা মানব-কল্যাণ সাধিত হয় না। 🔒ব্যাখ্যা সব ধর্ম আর ধর্ম-প্রবর্তকেরা বারংবার নির্দেশ দিয়েছেন মানুষের ভাল করো, মানুষের কল্যাণ করো, সুখ শান্তি দান করো মানুষকে। এমন কি সর্বজীবে হিতের কথাও বলা হয়েছে। 🔒ব্যাখ্যা
অতএব আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে। 🔒ব্যাখ্যা নতুন পদ্ধতিতে–যা হবে বৈজ্ঞানিক, র্যাশনাল ও সুবুদ্ধি-নিয়ন্ত্রিত। সমস্যা যত বড় আর যত ব্যাপকই হোক না তার মোকাবেলা করতে হবে সাহস আর বুদ্ধিমত্তার সাথে। এড়িয়ে গিয়ে কিংবা জোড়াতালি দিয়ে কোনো সমস্যারই সমাধান করা যায় না।
আমাদের বিশ্বাস মুক্তবুদ্ধির সহায়তায় সুপরিকল্পিত পথেই কল্যাণময় পৃথিবী রচনা সম্ভব। একমাত্র মুক্ত বিচারবুদ্ধির সাহায্যেই বিজ্ঞানের অভাবনীয় আবিষ্কারকে ধ্বংসের পরিবর্তে সৃজনশীল মানবিক কর্মে করা যায় নিয়োগ। 🔒ব্যাখ্যা তা করা হলেই মানব কল্যাণ হয়ে উঠবে মানব-মর্যাদার সহায়ক। 🔒ব্যাখ্যা