কবি-পরিচিতি :
নাম : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
জন্ম :১৫ই সেপ্টেম্বর ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দ।
স্থান :ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে।
শিক্ষা :আর্থিক সংকটের কারণে এফ.এ. শ্রেণিতে পড়ার সময় শরৎচন্দ্রের ছাত্র জীবনের অবসান ঘটে।
পেশা :১৯০৩ সালে ভাগ্যের সন্ধানে বর্মা মুল্লুকে (বর্তমানে মিয়ানমার) যান এবং রেঙ্গুনে একাউন্ট্যান্ট জেনারেলের অফিসে কেরানি পদে চাকরি করেন। তবে তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় কাটে সাহিত্য সাধনায়।
সাহিত্য সাধনা :
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ:
উপন্যাস : পরিণীতা, বিরাজ বৌ, প-িতমশাই, পল্লিসমাজ, বৈকুণ্ঠের উইল, দেবদাস, চরিত্রহীন, শ্রীকান্ত,
দত্তা, গৃহদাহ, বামুনের মেয়ে, পথের দাবী, শেষ প্রশ্ন, দেনা পাওনা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
বড় গল্প : রামের সুমতি, বিন্দুর ছেলে, বড় ছেলে, মেজদিদি প্রভৃতি।
ছোট গল্প : হরিলক্ষ্মী মহেশ, বিলাসী, সতী ইত্যাদি
প্রবন্ধগ্রন্থ : তরুণের বিদ্রোহ, স্বদেশ ও সাহিত্য।
মৃত্যু :১৬ই জানুয়ারি ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দ।
সাহিত্যকর্ম |
গ্রন্থের নাম | প্রকাশকাল | প্রকৃতি | গ্রন্থের উপজীব্য বিষয় |
Rajmohans Wife | উপন্যাস | ১৮৬৪ | বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস। এটি ১৮৬৪ সালে 'ওহফরধহ ঋরবষফ' নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। |
দুর্গেশনন্দিনী | উপন্যাস | মার্চ, ১৮৬৫ | ঐতিহাসিক উপন্যাস। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম বাংলা উপন্যাস। রচনাকাল ১৮৬২-৬৪। বঙ্কিমচন্দ্রের জীবিতকালে উপন্যাসের তেরটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ সংস্করণ মুদ্রিত হয় ১৮৯৩ সালে। |
কপালকুণ্ডলা | উপন্যাস | ১৮৬৬ | কাব্যিক উপন্যাস। বঙ্কিমচন্দ্রের দ্বিতীয় উপন্যাস। মেদিনীপুর জেলার নেগুঁয়া মহকুমায় (বর্তমানে কাঁথি মহকুমা, পূর্ব মেদিনীপুর জেলা) অবস্থানকালে অর্জিত কিছু অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই উপন্যাস রচনা করেন বঙ্কিমচন্দ্র। সমালোচক মহলে উচ্চ-প্রশংসিত হয় এই উপন্যাস। |
মৃণালিনী | উপন্যাস | ১৮৬৯ | ঐতিহাসিক উপন্যাস। খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর পটভূমিতে রচিত। |
বিষবৃক্ষ | উপন্যাস | ১৮৭৩ | সামাজিক উপন্যাস। বঙ্গদর্শন পত্রিকার প্রথম সংখ্যা (বৈশাখ, ১২৭৯) থেকে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। মোট সংস্করণের সংখ্যা আট। সর্বশেষ সংস্করণ মুদ্রিত হয় ১৮৯২ সালে। |
ইন্দিরা | উপন্যাস | ১৮৭৩ | অনু-উপন্যাস। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় (চৈত্র, ১২৭৯) ছোটোগল্প আকারে প্রকাশিত হয়। ১৮৭৩ সালে ৪৫ পৃষ্ঠার ক্ষুদ্র গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। ১৮৯৩ সালে ১৭৭ পৃষ্ঠার একটি অনু-উপন্যাসের আকারে এই গ্রন্থের পঞ্চম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। |
যুগলাঙ্গুরীয় | উপন্যাস | ১৮৭৪ | ঐতিহাসিক অনু-উপন্যাস। প্রথম প্রকাশ বঙ্গদর্শন পত্রিকায় (বৈশাখ, ১২৮০)। প্রথম সংস্করণে পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ৩৬। ১৮৯৩ সালে পঞ্চম তথা সর্বশেষ সংস্করণে পৃষ্ঠা সংখ্যা হয় ৫০। |
চন্দ্রশেখর | উপন্যাস | ১৮৭৫ | রোম্যান্সধর্মী উপন্যাস। প্রথম প্রকাশ বঙ্গদর্শন পত্রিকায় (শ্রাবণ, ১২৮০ -ভাদ্র, ১২৮১)। বঙ্কিমচন্দ্রের জীবিতকালে তিনটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ সংস্করণ ১৮৮৯ সালে মুদ্রিত। |
রাধারাণী | উপন্যাস | ১৮৮৬ | অনু-উপন্যাস। প্রথম প্রকাশ বঙ্গদর্শন পত্রিকায় (কার্তিক-অগ্রহায়ণ, ১২৮২)। ১৮৭৭ ও ১৮৮১ সালে উপন্যাস – অর্থাৎ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপন্যাস সংগ্রহ গ্রন্থে সংকলিত হয়। ১৮৮৬ সালে গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশের সময় পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ৩৮। ১৮৯৩ সংস্করণে পৃষ্ঠাসংখ্যা বেড়ে হয় ৬৫। |
রজনী | উপন্যাস | ১৮৭৭ | রোম্যান্সধর্মী উপন্যাস। প্রথম প্রকাশ বঙ্গদর্শন পত্রিকায় (১২৮১-৮২)। বঙ্কিমচন্দ্রের জীবিতকালে তিনটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ সংস্করণ ১৮৮৭ সালে মুদ্রিত। |
কৃষ্ণকান্তের উইল | উপন্যাস | ১৮৭৮ | সামাজিক উপন্যাস। ১৮৮২ ও ১৮৮৪ সালে বঙ্গদর্শন পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের জীবিতকালে চারটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ সংস্করণ ১৮৯২ সালে মুদ্রিত। |
রাজসিংহ | উপন্যাস | ১৮৮২ | ঐতিহাসিক উপন্যাস। প্রথম প্রকাশ বঙ্গদর্শন পত্রিকায় (চৈত্র, ১২৮৪ – ভাদ্র, ১২৮৫)। পত্রিকায় অসমাপ্ত উপন্যাসটি সমাপ্ত করে ১৮৮২ সালে ৮৩ পৃষ্ঠার প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় সংস্করণে পৃষ্ঠাসংখ্যা বেড়ে হয় ৯০। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ সংস্করণে পৃষ্ঠাসংখ্যা হয় ৪৩৪। |
আনন্দমঠ | উপন্যাস | ১৮৮২ | বঙ্কিমচন্দ্রের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক উপন্যাস। প্রথম প্রকাশ বঙ্গদর্শন পত্রিকায় (চৈত্র, ১২৮৭ - জ্যৈষ্ঠ, ১২৮৯)।-১৮৯২ সালে মুদ্রিত। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় স্তোত্র বন্দেমাতরম্ এই উপন্যাস থেকে গৃহীত। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পটভূমিকায় সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ছায়া অবলম্বনে রচিত। এই উপন্যাসে লেখকের দেশপ্রেম ফুটে উঠেছে। |
দেবী চৌধুরাণী | উপন্যাস | ১৮৮৪ | ঐতিহাসিক উপন্যাস। বিভিন্ন সময়ে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের জীবিতকালে ছয়টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ সংস্করণ ১৮৯১ সালে মুদ্রিত। |
সীতারাম | উপন্যাস | মার্চ, ১৮৮৭ | ঐতিহাসিক উপন্যাস। বঙ্কিমচন্দ্রের শেষ উপন্যাস। প্রচার পত্রিকায় (শ্রাবণ, ১২৯১- মাঘ, ১২৯৩; মাঝে কয়েকমাসের বিরতি সহ) প্রকাশিত হয়। প্রথম সংস্করণে পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ৪১৯। তৃতীয় ও শেষ সংস্করণ বঙ্কিমচন্দ্রের জীবদ্দশায় মুদ্রিত হলেও প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে, ১৮৯৪ সালের মে মাসে। |
লোকরহস্য | প্রবন্ধ | ১৮৭৪ | লোকরহস্য গ্রন্থের প্রবন্ধগুলো হলো: ব্যাঘ্রচার্য বৃহল্লাঙ্গুল, ইংরাজস্তোত্র, বাবু, গর্দভ, দাম্পত্য দ-বিধির আইন, বসন্ত এবং বিরহ, সুবর্ণগোলক, রামায়ণের সমালোচন, বর্ষ সমালোচন, কোন 'স্পেশিয়ালের' পত্র, BRANSONISM, হনুমদ্বাবুসংবাদ, গ্রাম্য কথা(প্রথম সংখ্যা, দ্বিতীয় সংখ্যা), বাঙ্গালা সাহিত্যের আদর, New Year's Day. |
বিজ্ঞান রহস্য | প্রবন্ধ | ১৮৭৫ | |
কমলাকান্তের দপ্তর | প্রবন্ধ | ১৮৭৫ | |
বিবিধ সমালোচনা | ১৮৭৬ | ||
সাম্য | প্রবন্ধ | ১৮৭৯ | |
কৃষ্ণচরিত্র | প্রবন্ধ | ১৮৮৬ | |
ধর্মতত্ত্ব অনুশীলন | প্রবন্ধ | ১৮৮৮ | |
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা | প্রবন্ধ | ১৯০২ |
ছন্দে ছন্দে সাহিত্যকর্ম:
► ছন্দে ছন্দে উপন্যাস: বড়দিদি, বিরাজ বৌ ও দত্তা ষড়যন্ত্র করে বামুনের মেয়েকে চরিত্রহীন বললে শ্রীকান্ত ও
পরিণীতার মধ্যে গৃহদাহ শুরু হয়ে যায়। পরবর্তীতে দেবদাস শেষের পরিচয়ের চন্দ্রনাথকে
দেনাপাওনার বিষয়ে পল্লীসমাজের পণ্ডিত মশাইয়ের কাছে শেষ প্রশ্ন করে বৈকুণ্ঠের উইল
সম্পর্কে জানতে পারে।
► ছন্দে ছন্দে ছোটগল্প: মন্দির, বিলাসী ও অনুরাধা রামের সুমতি পাবার আশায় বিন্দুর ছেলে মহেশকে নিয়ে অভাগীর
স্বর্গে গেল।
► ছন্দে ছন্দে প্রবন্ধ: স্বদেশ ও সাহিত্য প্রবন্ধে উনবিংশ শতাব্দীর তরুণের বিদ্রোহের মূল বিষয় ছিল স্বরাজ
সাধনায় নারী এবং ভবিষ্যৎ বঙ্গ সাহিত্যে নারীর মূল্য।
কবি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
* শরৎচন্দ্রের রচনায় মানব চরিত্র ও সমাজ সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় - সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ও সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাবলীল ও মনোরম প্রকাশভঙ্গি।
* শরৎচন্দ্রের রচনার ভাষা ছিল - অনাড়ম্বর ও প্রাঞ্জল।
* শরৎচন্দ্রের যে উপন্যাস নিয়ে বাংলা ও হিন্দিতে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে - দেবদাস।
* শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘নারীর মূল্য’ প্রবন্ধটি লিখেছেন - ‘অনিলা দেবী’ ছদ্মনামে।
* ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়েছিল তাঁর - পথের দাবী উপন্যাসটি।
* শরৎচন্দ্রের আত্মচরিতমূলক (আত্মজৈবনিক) শ্রেষ্ঠ উপন্যাস - শ্রীকান্ত (খ- ৪টি)।
* তাঁর রাজনৈতিক উপন্যাস ‘পথের দাবী' বাজেয়াপ্ত হয় - ১৯২৬ সালে।
* বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কিশোর চরিত্র - ইন্দ্রনাথ।
* রাজলক্ষ্মী, ইন্দ্রনাথ, অন্নদা, শ্রীকান্ত যে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র - শ্রীকান্ত।
* শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম মুদ্রিত রচনার নাম - মন্দির (ছোটগল্প)।
* বাঙালি নারীর প্রতিকৃতি অঙ্কনে অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছেন - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
* শরৎচন্দ্রের শিল্পীমানসের মৌলবৈশিষ্ট্য মানবতা ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা।
* শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের যে শাখায় সবচেয়ে জনপ্রিয় - উপন্যাস।
* শরৎচন্দ্রের ‘বিলাসী’ গল্পটি যে গল্পগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত - ছবি।
* ‘মেজদিদি’ গল্পটির প্রধান চরিত্র - হেমাঙ্গিনী ও কাদম্বিনী।
* ত্রিভুজ প্রেমের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে শরৎচন্দ্রের - গৃহদাহ উপন্যাসে (নারী চরিত্র : অচলা)।
* ‘দত্তা’ উপন্যাসের নাট্যরূপ যে নাটকটি - বিজয়া।
* ‘দেনা-পাওনা” উপন্যাসের নাট্যরূপ যে নাটকটি - ষোড়শী।
* ‘পল্লী সমাজ’ উপন্যাসের নাট্যরূপ যে নাটকটি - রমা।
* তাঁর রচনায় বাস্তবরূপে চিত্রিত হয়েছে - বাঙালি নারীর সংস্কারাবদ্ধ জীবন, নারীদের প্রতি সামাজিক নির্যাতন এবং সমাজের বৈষম্য ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
উৎস পরিচিতি:
শরৎচন্দ্রের “বিলাসী” গল্পটি প্রথমে প্রকাশিত হয় ‘ভারতী' পত্রিকায় ১৩২৫ বঙ্গাব্দের (১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ) বৈশাখ সংখ্যায়। “ন্যাড়া” নামের এক যুবকের নিজের জবানিতে বিবৃত হয়েছে এ গল্প। এই গল্পের কাহিনিতে শরৎচন্দ্রের প্রথম জীবনের ছায়াপাত ঘটেছে।
মূল ভাব:
শরৎচন্দ্রের “বিলাসী” গল্পটি প্রথমে প্রকাশিত হয় ‘ভারতী' পত্রিকায় ১৩২৫ বঙ্গাব্দের (১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ) বৈশাখ সংখ্যায়। “ন্যাড়া” নামের এক যুবকের নিজের জবানিতে বিবৃত হয়েছে এ গল্প। এই গল্পের কাহিনিতে শরৎচন্দ্রের প্রথম জীবনের ছায়াপাত ঘটেছে।
“বিলাসী” গল্পে বর্ণিত হয়েছে ব্যতিক্রমধর্মী দুই মানব-মানবীর চরিত্রের অসাধারণ প্রেমের মহিমা, যা ছাপিয়ে উঠেছে জাতিগত বিভেদের সংকীর্ণ সীমা। গল্পে সংঘটিত একের পর এক ঘটনা এবং বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে সংঘাতের মাধ্যমেই কাহিনি অগ্রসর হয়। ঘটনার দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে কাহিনিতে গতি সঞ্চারিত হয়েছে। লেখক কোন অবস্থান থেকে কাহিনি বলছেন, সেটা অনেক সময় কাহিনি বর্ণনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । লেখক সর্বদর্শী অবস্থান থেকেও কাহিনি বর্ণনা করতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিনি সবগুলো চরিত্র ও ঘটনাÍ নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে বর্ণনা করেন। যেমনটি দেখা যায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ‘লালসালু' উপন্যাস এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের “মাসি-পিসি” গল্পে। পক্ষান্তরে গল্পটি উত্তম পুরুষের ভাষ্যেও বর্ণিত হতে পারে। এক্ষেত্রে গল্পে আমি, আমাকে ইত্যাদি সর্বনাম এসে যায়। এরকম ক্ষেত্রে কখনো-কখনো লেখক নিজেই কাহিনির একটা চরিত্রের ভূমিকা নেন, হয়ে ওঠেন কথক । “বিলাসী” গল্পে লেখক সেই ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। বর্তমান সংকলনের “অপরিচিতা”, “আহ্বান” ও “তাজমহল” গল্পে উত্তমপুরুষের ভাষ্য গৃহীত হয়েছে। “বিলাসী” গল্পের নাম চরিত্র কর্মনিপুণ, বুদ্ধিমতী ও সেবাব্রতী বিলাসী; শরৎসাহিত্যের অন্যান্য উজ্জ্বল নায়িকাদের মতোই একজন। যে প্রেমের জন্যে নির্দ্বিধায় বেছে নিয়েছে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ আর তার প্রেমের মহিমাময় আলোয় ধরা পড়েছে সমাজের অনুদারতা ও রক্ষণশীলতা, জীবনের নিষ্ঠুর ও অশুভ চেহারা ।
১) শরৎচন্দ্রের প্রথম মুদ্রিত রচনা কোনটি? [রা.বো.২২]
২) ‘বিলাসী’ গল্পে মৃত্যুঞ্জয় প্রসঙ্গে ‘সুনাম’ কথাটি দ্বারা কী প্রকাশ পেয়েছে? [সি.বো.২৩]
৩) ‘গ্রামের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয়ের ছিল এমনি সুনাম।” ‘সুনাম’ কথাটা কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে? [রা.বো.২২]
৪) মৃত্যুঞ্জয় কোন ক্লাসে পড়তো? [ব.বো.২২]
৫) “উপরের আদালতের হুকুম” বলতে কার নির্দেশ বোঝানো হয়েছে? [ম.বো.২২]
১) 'বদন দগ্ধ না হয়' দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে?
২) ভূদেবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের পারিবারিক প্রবন্ধের বিষয়বস্তু কী ছিল?
৩) 'বিলাসী' গল্পে 'বাঙালির বিষ' কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে?
৪) গুলি বলতে 'বিলাসী' গল্পে কী বোঝানো হয়েছে?
৫) 'কামাখ্যা' কোথায় অবস্থিত?
ক) খুড়া মিত্তির বংশের। |
খ) ‘ইহা আর একটি শক্তি’- কথাটি দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার প্রকৃত ভালোবাসার প্রসঙ্গকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। স্বামী-স্ত্রী বহুবছর একত্রে বসবাস করলেও সত্যিকারের ভালোবাসার সন্ধান খুব কম যুগলই পায়। আলোচ্য গল্পে প্রসঙ্গক্রমে গল্পকথক তাঁর এক আত্মীয়ার উদাহরণ টেনেছেন। সেই নারী স্বামীর সাথে পঁচিশ বছর ঘর করেছে। অথচ স্বামীর মৃতদেহ আগলে পাঁচ মিনিটও একাকী থাকার সাহস তার নেই। এর কারণ প্রকৃত ভালোবাসার সম্পর্কের অনুপস্থিতি। স্বামীর মৃতদেহের কাছে থাকার জন্য প্রয়োজন ছিল আর একটু শক্তি, অর্থাৎ খাঁটি ভালোবাসা। প্রশ্নোক্ত উদ্ভিটির মধ্য দিয়ে এ বিষয়টিই ইঙ্গিতময় হয়ে উঠেছে। |
গ) বিলাসী চরিত্রের করুণ পরিণতির দিকটি উদ্দীপকের খনার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। ‘বিলাসী’গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র বিলাসী। উচ্চবর্ণের মৃত্যুঞ্জয় তাকে ভালোবেসে বিয়ে করে। কিন্তু রক্ষণশীল সমাজ তাদের এই সম্পর্ককে মেনে নেয়নি। ফলে সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে মৃত্যুঞ্জয় নিজের জাত বিসর্জন দিয়ে সাপুড়ে হয়ে ওঠে। একদিন গোখরো সাপ ধরতে গিয়ে সাপের কামড়ে তার মৃত্যু হয়। স্বামীর মৃত্যুর শোক সইতে না পেরে বিলাসীও বিষপানে আত্মহত্যা করে। উদ্দীপকে উল্লিখিত খনা জ্যোতির্বিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তাঁর দেওয়া পূর্বাভাসে কৃষকরা উপকৃত হলে রাজদরবারে তাঁর মর্যাদা বেড়ে যায়। তাঁর এই সুনাম অর্জনের বিষয়টিকে শ্বশুর বরাহ ভালোভাবে নেননি। শুধু তাই নয়, রাজসভায় প্রতিপত্তি এবং নারীর কাছে সম্মান হারানোর ভয়ে তাঁর শ্বশুর বরাহ নিজের ছেলেকে খনার জিহ্বা কেটে নেওয়ার আদেশ দেন। পিতার আদেশ মতো পুত্র মিহির নিজ স্ত্রী খনার জিভ কেটে নিলে কিছুদিন পর খনার মৃত্যু হয়। একইভাবে, ‘বিলাসী’গল্পের বিলাসীও রক্ষণশীল সমাজের প্রতিহিংসার শিকার। এ কারণেই তার স্বামী মৃত্যুঞ্জয়কে সর্বস্ব হারিয়ে সাপুড়ে হতে হয় এবং পরিণতিতে সর্প দংশনে মৃত্যু হয় তার। আর পতিঅন্ত্য প্রাণ বিলাসীও স্বামীর মৃত্যু শোক সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে। অর্থাৎ প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও আলোচ্য গল্পের বিলাসী এবং উদ্দীপকের খনা উভয়েই করুণ পরিণতির শিকার। এ দিক থেকে খনার সাথে বিলাসীর সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। |
ঘ. মৃত্যুঞ্জয় স্ত্রীকে গভীরভাবে ভালোবাসলেও উদ্দীপকের মিহির স্ত্রীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘বিলাসী’গল্পটি বিলাসী ও মৃত্যুঞ্জয়ের প্রণয় এবং তাদের করুণ পরিণতিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। মৃত্যুপথযাত্রী মৃত্যুঞ্জয়কে নিম্নবর্ণের বিলাসী সেবা-শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তুললে ভালোবেসে তাকে বিয়ে করে সে। বিলাসীর হাতে মৃত্যুঞ্জয় ভাত খাওয়ার অজুখতে গ্রামবাসীর প্রতিহিংসার শিকার হয় তারা। অবশেষে মৃত্যুঞ্জয় জাত বিসর্জন দিয়ে বিলাসীর সাথে ঘর বাঁধে এবং পুরোদস্তুর সাপুড়ে হয়ে ওঠে। উদ্দীপকের মিহিরের স্ত্রী খনা ছিলেন অত্যন্ত গুণী। জ্যোতির্বিদ শ্বশুর ও স্বামী আকাশের তারা গণনা করতে গিয়ে সমস্যায় পড়লে বন্য নারীর কাছে প্রতিপত্তি হারানোর বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি। পরিশেষে তাঁর নির্দেশে পুত্র মিহির খনার জিহ্বা কেটে নিলে ঘনায় মৃত্যু হয়। স্ত্রীর প্রতি মিহিরের এমন ঘৃণ্য আচরণের বিপরীতে আলোচ্য গল্পের মৃত্যুঞ্জয় স্ত্রী বিলাসীর প্রতি অনুরত্ব ও দায়িত্বশীল ছিল। সাপুড়ে মৃত্যুঞ্জয় অকৃত্রিমভাবে বিলাসীকে ভালোবেসেছে। নিজে উচ্চবর্ণের হলেও সাপুড়ের মেয়ে বিলাসীকে বিয়ে করতে দ্বিধা করেনি সে। তাদের ভালোবাসা রক্ষণশীল ও অনুদার গ্রামীণ সমাজ মেনে নিতে না পারায় সে জাত বিসর্জন দিয়েছে অবলীলায়। বিলাসীর সাথে। বেদেপল্লিতে গিয়ে ঘর বেঁধে সাপুড়ে হয়েছে। নিজের বিশাল সহায়-সম্পত্তি হারানোর ভয় তাকে এতটুকুও আচ্ছন্ন করেনি। পক্ষান্তরে, উদ্দীপকের মিহির স্ত্রীর খ্যাতিতে খুশি না হয়ে বরং প্রতিহিংসাপরায়ণ পিতার কথায় তার জিহ্বা কেটে নেওয়ার মতো গর্হিত কাজ করেন। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা থাকলে তিনি এমনটি অন্যায় করতে পারতেন না। সেদিক বিবেচনায় প্রশ্নোক্ত মন্তব্যটি যথাযথ। |
ক) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৬ সালে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে সম্মানসূচক ডি.লিট ডিগ্রী প্রদান করে। |
খ) ন্যাড়া যাতে সাপ ধরার মতো ভয়ংকর পেশায় নিয়োজিত না থাকে সেজন্যই স্বামীর মৃত্যুর পর বিলাসী তাকে এ পেশা ছাড়ার জন্য দিব্যি দেয়। বিলাসী জাত সাপুড়ের মেয়ে। সে জানত সাপ খুব ভয়ংকর প্রাণী, যেকোনো মুহূর্তে সাপুড়েকেও কামড়াতে পারে। সাপ সম্বন্ধে তার এ ধারণা সত্যিও হয়েছিল। একদিন সাপের কামড়েই তার প্রিয়জন মৃত্যুঞ্জয়কে হারাতে হয়েছে। সে জানে, এ পেশা না ছাড়লে হয়তো ন্যাড়ারও শেষ পরিণতি হবে মৃত্যু। তাই বিলাসী তাকে এ পেশা ছাড়ার জন্য দিব্যি দেয়। |
গ) গফুরের জীবনবাস্তবতার সঙ্গে ‘বিলাসী’ গল্পের মৃত্যুঞ্জয়ের সমাজচ্যুত হওয়ার ঘটনার সাদৃশ্য রয়েছে। ‘বিলাসী’ গল্পের মৃত্যুঞ্জয় অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে সেবা-শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলে সাপুড়ের মেয়ে বিলাসী। পরে বিলাসীর গুণোমুগ্ধ হয়ে তাকে ভালোবাসে বিয়ে করে মৃত্যুঞ্জয়। মৃত্যুঞ্জয় ব্রাহ্মণ এবং বিলাসী নিচু জাতের সাপুড়ের মেয়ে হওয়ায় বিলাসীর হাতে ভাত খাওয়া মৃত্যুঞ্জয়ের জন্য অন্নপাপ বলে গণ্য করে গ্রামবাসী। এজন্য রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ মৃত্যুঞ্জয়কে সমাজচ্যুত করলে জাত বিসর্জন দিয়ে সাপুড়ে হতে হয় তাকে। উদ্দীপকের গফুর রাগের বশে লাঙলের ফলা দিয়ে তার প্রিয় গোরু মহেশকে আঘাত করে। ফলে মহেশ মরা যায়, যা তাকে অত্যন্ত ব্যথিত করে। কিন্তু তার ফলে সমাজপতিদের চাপে তাকে গো-হত্যার প্রায়শ্চিত্ত করার মতো শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। তাই শাস্তি থেকে বাঁচতে বাধ্য হয়ে গফুর রাতের অন্ধকারে মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যায়। উদ্দীপকের গফুর যে গোরুটিকে ভালোবাসতেন সেটি তার অনিচ্ছাকৃত ভুলে মারা যায় তবুও সমাজের ভয়ে তাকে তার বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়। অন্যদিকে ‘বিলাসী’ গল্পের মৃত্যুঞ্জয় বিলাসীকে ভালোবাসে বিয়ে করার ফলে সমাজচ্যুত হয়। রক্ষণশীল সমাজের ভয়ে গফুরের মেয়েকে নিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার সঙ্গে ‘বিলাসী’ গল্পে বিলাসী ও মৃত্যুঞ্জয়ের সমাজচ্যুত জীবনযাপন করার ঘটনাটি সাদৃশ্যপূর্ণ। |
ঘ) তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজবাস্তবতায় নিরিখে উদ্দীপকের ‘গো-হত্যা’ এবং ‘বিলাসী’ গল্পের ‘অন্নপাপ’ মূলত একই সূত্রে গাঁথা। ‘বিলাসী’ গল্পে মৃত্যুঞ্জয় ব্রাহ্মণ হলেও বিলাসী ছিল তথাকথিত নিচু জাতের সাপুড়ের মেয়ে। তৎকালীন রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের উঁচু জাতের কোনো ব্যক্তি নিচু জাতের কারো হাতে ভাত খেলে ‘অন্ন-পাপ’ হিসেবে গণ্য করা হতো। অসুস্থ মৃত্যুঞ্জয় বিলাসীর সেবায় সুস্থ হয়ে তাকে ভালোবেসে বিয়ে করে সংসার করে এবং তার হাতে ভাতও খায়। এজন্য রক্ষণশীল হিন্দু-সমাজ মৃত্যুঞ্জয়কে অন্ন-পাপের অভিযোগে সমাজচ্যুত করলে সে জাত বিসর্জন দিয়ে সাপুড়ে হয়ে যায়। উদ্দীপকের গফুরের প্রিয় গোরু মহেশ। দারিদ্র্যের কারণে গফুর ঠিকমতো তার খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে না। একদিন তৃষ্ণার্ত মহেশ গফুরের মেয়ের মাটির পাত্র ভেঙে ফেললে গফুর রাগের মাথায় মহেশকে আঘাত করলে ফলে মহেশ মারা যায়। এমতাবস্থায় গো-হত্যার অভিযোগে তাকে কঠোর সম্মুখীন হতে হবে। তাই নিজেকে বাঁচাতে সে মেয়েকে নিয়ে রাতের আঁধারে পালিয়ে যায়। তার এই গ্রামছাড়া হওয়ার কারণ তৎকালীন সমাজের কুসংস্কার ও সংকীর্ণ চিন্তাধারা। ‘বিলাসী’ গল্পে গল্পকার তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজের ভয়াবহ রূপ উন্মোচন করেছেন। অসম বর্ণের হওয়ায় সেই সমাজ বিলাসী-মৃত্যুঞ্জয়ের বিয়েকে স্বীকৃতি দেয় না। উপরন্তু অন্ন-পাপের অজুহাতে তাদের নিপীড়ন করে গ্রামছাড়া করে। ফলে বাধ্য হয়েই মৃত্যুঞ্জয়কে সাপুড়ে জীবন গ্রহণ করতে হয় এবং পরিণতিতে সর্পদংশনে তার মৃত্যু হয়। একইভাবে, গো-হত্যার কারণে রক্ষণশীল সমাজের শাস্তির ভয়েই গফুরকেও গ্রাম ছাড়তে হয়। এই গো-হত্যাজনিত অপরাধ বা অন্ন-পাপ মূলত রক্ষণশীল মানসিকতাই প্রকাশ। এ দিক বিচারে প্রশ্নোক্ত মন্তব্যটি যথাযথ। |
ক) ‘বিলাসী’ গল্পের ন্যাড়া প্রায় দুই ক্রোশ পথ হেঁটে স্কুলে যেত। |
খ) ‘গ্রামটা এবার রসাতলে গেল’Ñ একথা মৃত্যুঞ্জয়ের খুড়া মৃত্যুঞ্জয়-বিলাসীর পরিণয় মেনে নিতে পারেননি বলে বলেছেন। ‘বিলাসী’ গল্পে বর্ণপ্রথায় আচ্ছন্ন বাঙালি সমাজের কথা বর্ণিত হয়েছে। মানুষ নয় বর্ণভেদই তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মৃত্যুঞ্জয় কায়স্থের ছেলে হয়ে বিলাসীকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে, এটি সমাজ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। সাপুড়ের মেয়েকে বিয়ে এবং তার হাতে অন্নগ্রহণ মৃত্যুঞ্জয়ের জন্য মহাপাপ বলে বিবেচিত হয়। বিশেষত মৃত্যুঞ্জয়ের খুড়া এ বিষয়ে তীব্রকণ্ঠ। তিনি এতে সামাজিক রীতিনীতি ধ্বংস হওয়ার আলামত দেখে এহেন মন্তব্য করেছেন। |
গ) স্বর্ণময়ী ‘বিলাসী’ গল্পের বিলাসী চরিত্রের দুঃসময়ের সারথি হওয়ার দিকটির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। ‘বিলাসী’ গল্পের বিলাসী একজন সাপুড়ে কন্যা। মৃত্যুঞ্জয়ের কঠিন পীড়ার সময় সে তাকে সেবা-শুশ্রƒষা দিয়ে সুস্থ করে তোলে। দুঃসময়ে কেউ মৃত্যুঞ্জয়ের পাশে না থাকলেও বিলাসী সারথি হিসেবে পাশে ছিল। উদ্দীপকের স্বর্ণময়ীর বাবা বয়সের ভারে ন্যূব্জ হয়ে পড়েছেন। দীর্ঘদিন পথঘাটে সাপ খেলা দেখিয়ে সংসার চালালেও এখন আর তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কয়েকদিন ধরে ঘরে খাবারের ব্যবস্থা করাও সম্ভব হয়নি। পরিবারের এমন দুঃসময়ে সাপুড়ে কন্যা স্বর্ণময়ী সাপ খেলা দেখাতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। তার এমন বৈশিষ্ট্য ‘বিলাসী’ গল্পের সাপুড়ে কন্যা বিলাসীর দুঃসময়ে মৃত্যুঞ্জয়ের সান্নিধ্যে ও সেবায় নিয়োজিত থাকার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। |
ঘ) উদ্দীপকের রাজন ও ‘বিলাসী’ গল্পের মৃত্যুঞ্জয় সমাজচ্যুত হওয়ার প্রেক্ষাপট আলাদা হওয়ায় প্রশ্নোক্ত উক্তিটি যথার্থ। ‘বিলাসী’ গল্পের বিলাসী উদার ও সেবাপরায়ণ মনোভাবাপন্ন নারী। নিচু জাতের মেয়ে হয়েও বিলাসী অসুস্থ মৃত্যুঞ্জয়কে সেবা-শুশ্রƒষা করে সুস্থ করে তোলে। পোড়োবাড়িতে একা রাত জেগে সে দিন-রাত মৃত্যুঞ্জয়ের সেবা করে গেছে। মৃত্যুঞ্জয় এই সেবার প্রতিদান দিতে ভুল করেনি। সে বিলাসীকে বিয়ে করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। কিন্তু নিচু জাতের মেয়ে বিয়ে করায় মৃত্যুঞ্জয়কে সমাজচ্যুত হতে হয়। উদ্দীপকে সাপুড়ে ঝড়– সর্দারের মেয়ে স্বর্ণময়ী। বার্ধক্যের কারণে তার বাবা সাপ খেলা দেখাতে না পারায় অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে পরিবার। পরিবারে এমন পরিস্থিতিতে স্বর্ণময়ী নিজেই সাপ খেলা দেখানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তাতেও লাভ হয় না। কারণ মানুষ এখন আর সাপ খেলা দেখতে চায় না। ফলে অর্থনৈতিক সংকট আরও তীব্র হতে থাকে। এমতাবস্থায় প্রতিবেশী ছেলে রাজন স্বর্ণময়ীকে বিয়ে করে সাহায্য করে। কিন্তু নিচু জাতের মেয়েকে বিয়ে করায় সমাজ তাদের একঘরে করে রাখে। ‘বিলাসী’ গল্পে অসুস্থ মৃত্যুঞ্জয়কে সেবা-শুশ্রƒষা করে সুস্থ করে তোলে নিচু জাতের সাপুড়ে মেয়ে বিলাসী। পরে মৃত্যুঞ্জয় ভালোবেসে বিলাসীকে বিয়েও করে। নিচু জাতের সাপুড়ের মেয়েকে বিয়ে করায় মৃত্যুঞ্জয়ের বিরুদ্ধে জাত বিসর্জনের অভিযোগ তোলা হয়। উদ্দীপকেও ব্রাহ্মণের ছেলে রাজন সাপুড়ের মেয়ে স্বর্ণময়ীকে বিয়ে করায় সমাজচ্যুত হয়। তাদের উভয়ের পরিণতি এক হলেও প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। বিলাসী অসুস্থ মৃত্যুঞ্জয়ের সেবা করেছিল নিতান্তই ভালোবেসে আর মৃত্যুঞ্জয়ও সেই ভালোবাসার প্রতিদান দিয়েছে বিলাসীকে বিয়ে করে। কিন্তু রাজন ও স্বর্ণময়ীর ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেনি; রাজন শুধু অর্থনৈতিক সংকটে থাকা স্বর্ণময়ীকে বিয়ে করে সহযোগিতা করতে চেয়েছিল। তাই উদ্দীপকের ভাববস্তু এবং ‘বিলাসী’ গল্পের প্রেক্ষাপট ভিন্ন বলা যায়। |
ক) এডেন সামুদ্রিক লবন তৈরির জন্য বিখ্যাত। |
খ) অসুস্থ মৃত্যুঞ্জয়ের নিবিড় সেবা করার পর বিলাসী নিজেই রোগা হয়েছে এটা বোঝাতেই লেখক উপমায় বিলাসীর অবস্থা বর্ণনা করেছেন। মৃত্যুপথযাত্রী মৃত্যুঞ্জয়কে সেবা করার দায়িত্ব নিয়েছে বিলাসী। ন্যাড়া মৃত্যুঞ্জয়কে দেখতে যায় বিলাসীর বাড়িতে। তাকে দেখে তার বয়স বুঝতে পারে না ন্যাড়া, কারণ রাত জেগে সেবা করতে করতে তার অবস্থাও খারাপ হয়েছে। মলিন চেহারার বিলাসীকে বর্ণনা করতেই বলা হয়েছে “ঠিক যেন ফুলদানিতে জল দিয়া ভিজাইয়া রাখা বাসি ফুলের মতো।” |
গ) প্রবন্ধে বিলাসী চরিত্রের প্রেমময়তা ও সেবাপরায়ণতার দিকটি উদ্দীপকের মহুয়ার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। ‘বিলাসী’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র বিলাসী মানবতাবোধ উদ্ভাসিত এক নারী। তাই মুমূর্ষু মৃত্যুঞ্জয়ের পাশে সে সেবার মানসিকতা নিয়ে দাঁড়িয়েছে। রোগীর পাশে থেকে বিলাসী সাধ্যমতো সেবা করেছে। মূলত তার সেবা-যতেœই মৃত্যুপথযাত্রী মৃত্যুঞ্জয় সুস্থ হয়ে ওঠে। এ সময়ের মধ্যে তাদের মাঝে প্রবল আবেগ ও প্রেমানুভূতি জাগ্রত হওয়ায় তারা বিয়ে করে নেন। কিন্তু তৎকালীন হিন্দুসমাজ জাতের দোহাই দিয়ে এই বিবাহের বিরুদ্ধে অবস্থান করে এবং গ্রামবাসীরা বিলাসীকে গ্রাম থেকে বের করে দিতে উদ্যত হয়। এমন পরিস্থিতিতে এসেও সে শুধু পীড়িত মৃত্যুঞ্জয়ের কথাই ভাবতে থাকে। উদ্দীপকে মহুয়া শহরের একটি পোশাক কারখানায় কর্মরত আছে। তার গ্রামের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষরা বিষয়টি পছন্দ না করায় তার নামে দুর্নাম রটনা করে। গ্রামবাসীরা তাকে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়। কিন্তু মহুয়া তার অসুস্থ মাকে রেখে কিছুতেই যাবে না বলে জানিয়ে দেয়। একইভাবে গল্পের বিলাসীও মৃত্যুপথগামী মৃত্যুঞ্জয়ের সেবা করতে সদা তৎপর। অর্থাৎ মহুয়া ও বিলাসী দুজনেই কোনো ধরনের প্রতিদানের প্রত্যাশা ছাড়াই মুমূর্ষু দুজন মানুষের সেবা করেছে, যা তাদের প্রেমময়তা ও সেবাপরায়ণ মানসিকতার পরিচায়ক। |
ঘ) অন্যায়ের প্রতিবাদ করার দিক দিয়ে গল্পের বিলাসী ও উদ্দীপকের মহুয়া পরস্পর বিপরীত চরিত্রের মানুষ। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বিলাসী’ গল্পে হিন্দু সমাজের প্রচলিত কুসংস্কারের চর্চা দেখানো হয়েছে। মৃত্যুঞ্জয় অসুস্থ হয়ে বিলাসীর সেবা গ্রহণ করে, তার হাতে ভাত খায়। এসব জানাজানি হলে মৃত্যুঞ্জয়ের খুড়া দলবল নিয়ে বিলাসীকে নির্যাতন করে। অন্নপাপের দায়ে বিলাসীর উপর এ নির্যাতন চালানো হয়। এছাড়া তাদের বিবাহের খবর শোনার পর জ্ঞাতি খুড়ো সাপুড়ে কন্যার জাতকে নিচু বলে অবজ্ঞা করে। বিলাসী নিরবে এসব নির্যাতন সহ্য করে এবং কোনো ধরনের প্রতিবাদ করে না। এমনকি তাকে যখন চুলের মুঠি ধরাসহ নানাভাবে শারীরিক নির্যাতন করা হয়, তখনও সে কেবল অসুস্থ মৃত্যুঞ্জয়ের কথা বলতে থাকে। উদ্দীপকে মহুয়া শহরের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করায় তার গ্রামবাসীরা তাকে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্য তারা মহুয়া সম্পর্কে দুর্নাম প্রচার করে। কিন্তু মহুয়া এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এবং অসুস্থ মাকে রেখে কোথাও যাবে না তা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়। কিন্তু বিলাসী গল্পের বিলাসী কোন প্রতিবাদ না করে নিরবে সব নির্যাতন সহ্য করেছে। উদ্দীপক ও বিলাসী গল্পের মাধ্যমে বোঝা যায়, মহুয়া ও বিলাসী উভয়ই নারী চরিত্র হলেও তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য রয়েছে। তারা দুজনই ব্যক্তিজীবনে কর্মঠ হলেও অধিকার বিষয়ে সচেতনতা শুধু মহুয়ার মাঝেই পরিলক্ষিত হয়। আর অন্যদিকে বিলাসী গ্রামের অনেকের কটু কথা শুনে এবং শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েও প্রতিবাদ করে না। সুতরাং এ বিষয়ে আমি একমত যে, বিলাসী ও মহুয়া পরস্পর বিপরীত চরিত্রের মানুষ। |
ক) ‘বিলাসী’ গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘ভারতী’ পত্রিকায়। |
খ) ‘বিলাসী’ গল্পে বর্ণিত মৃত্যুঞ্জয়ের পোড়োবাড়িটি মূলত কুড়ি-পঁচিশ বিঘার একটা প্রকা- আম বাগানের মধ্যে নির্জন পরিবেশে অবস্থিত ছিল। মৃত্যুঞ্জয় একটি বিশাল পুরনো বাড়িতে একাই বসবাস করত। এক জ্ঞাতি খুড়া ছাড়া তার মা-বাবা বা পরিজন কেউ ছিল না। গ্রামের এক প্রান্তে বড় বড় আমগাছে পরিপূর্ণ বাগানের মধ্যে ছিল তার বাড়ি। সেখানে সন্ধ্যা পেরোলে একটা জমাট অন্ধকারের মতো চারিদিক আচ্ছন্ন হয়ে যেত। |
গ) উদ্দীপকের নদের চাঁদ চরিত্রের সাথে ‘বিলাসী’ গল্পের মৃত্যুঞ্জয়ের চরিত্র তুলনীয়। ‘বিলাসী’ গল্পের জাতপ্রথার ভয়ানক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রথাগত দিক দিয়ে বিলাসী নিচু জাতের হলেও তার সেবাতে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করে মৃত্যুঞ্জয়। মৃত্যুপথযাত্রী মৃত্যুঞ্জয় বিলাসীর রান্না করা ভাতও খায়। আর ভাত খাওয়ার এ বিষয়টিই তৎকালীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দু সমাজের কাছে এবং খুড়ার কাছে ‘অন্নপাপ’ বলে বিবেচিত হয়। এই খবর শোনার পর খুড়া তার দলবল নিয়ে বিলাসীকে আক্রমণ করে। তার কাছে ছোটজাত, বড়জাতই প্রধান ছিল। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় কায়স্থের ছেলে হয়েও নিজের জাতটা বিসর্জন দিয়ে পুরাদস্তুর সাপুড়েতে পরিণত হয় এবং বিলাসীর সাথে সুখের সংসার শুরু করে। উদ্দীপকে জমিদার পুত্র নদের চাঁদ হুমরাবেদের মেয়ে মহুয়ার প্রেমে পড়ে। জমিদার বিষয়টি জানতে পেরে হুমরাবেদের দলকে গ্রাম থেকে উৎখাত করে। কেননা নিচু জাতের বেদের মেয়েকে তিনি কখনোই পুত্রবধূরূপে গ্রহণ করতে পারবে না। কিন্তু নদের চাঁদ মহুয়াকে পাওয়ার আশায় নিজের বাবা-মাকে পর্যন্ত ছাড়তে পিছপা হয়নি। আর এদিক থেকে উদ্দীপকের নদের চাঁদ ‘বিলাসী’ গল্পের মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। |
ঘ) উদ্দীপকটি যেন ‘বিলাসী’ গল্পের মৃত্যুঞ্জয়-বিলাসীর অমর প্রেমের উপাখ্যানÑ মন্তব্যটি যথার্থ। ‘বিলাসী’ গল্পে বিলাসী অসুস্থ মৃত্যুঞ্জয়কে সেবা-শুশ্রƒষা দিয়ে সুস্থ করে তোলে। এর প্রতিদানে মৃত্যুঞ্জয় তাকে ভালোবাসে। জাত-ধর্ম বিসর্জন দিয়ে তাকে বিয়ে করে নিজে সাপুড়ে জীবন গ্রহণ করে। মৃত্যুঞ্জয় সর্পদংশনে মারা গেলে বিলাসীর এ বিরহে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। উদ্দীপকের হুমরাবেদের মেয়ে মহুয়ার সাথে জমিদারপুত্র নদের চাঁদের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জমিদার তাদের সম্পর্কের কথা জানতে পেরে রাতের আঁধারেই হুমরাবেদের দলকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়। কেননা নিচু জাতের মেয়ের সাথে নিজ পুত্রের প্রেম কখনোই তিনি মানতে পারেননি। হুমরাবেদের দলকে গ্রামে না পেয়ে নদের চাঁদ মহুয়ার সন্ধানে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এমনকি মহুয়াকে পাওয়ার আশায় নিজ বাবা-মাকে ত্যাগ করে। কিন্তু নদের চাঁদ মহুয়াকে কাছে পেয়েও তার কাক্সিক্ষত জীবন সাজাতে ব্যর্থ হয়। কেননা হুমরাবেদে তাকে হত্যা করার জন্য মহুয়ার হাতে বিষলক্ষার ছুরি তুলে দেয়। ‘বিলাসী’ গল্পে বর্ণিত হয়ে ব্যতিক্রমধর্মী দুই মানব-মানবীর চরিত্রের অসাধারণ প্রেমের মহিমা, যা ছাপিয়ে উঠেছে জাতিগত বিভেদের সংকীর্ণ সীমা। একদিকে বিলাসী সবটুকু দিয়ে মৃত্যুঞ্জয়কে সেবা করেছে, সুস্থ করে তুলেছে। অন্যদিকে, মৃত্যুঞ্জয়ও বিলাসীকে বিয়ে করেছে, ঘর ছেড়েছে। একইভাবে উদ্দীপকেও প্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হয়। মৃত্যুঞ্জয় কিংবা নদের চাঁদ শ্রেণি, অর্থ, সমাজের চেয়ে তাদের ভালোবাসার নারীকেই প্রাধান্য দিয়েছে, তারা আরো প্রাধান্য দিয়েছে প্রেমকে, মানবতাকে। তাই বলা যায়, উদ্দীপকটি ‘বিলাসী’ গল্পের মৃত্যুঞ্জয়-বিলাসীর অমর প্রেমের উপাখ্যান। |