উমর ফারুক
কাজী নজরুল ইসলাম
লেখক পরিচিতি:
জন্ম: কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ২৪শে মে, বাংলা ১৩০৬ সালের ১১ই জ্যৈষ্ঠ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
পিতৃপরিচয়: কাজী নজরুল ইসলামের পিতার নাম- কাজী ফকির আহমদ।
শৈশব: নজরুলের শৈশব কাটে কঠিন জীবনসংগ্রামরে মধ্য দিয়ে। তিনি গ্রামের মক্তর থেকে উত্তীর্ণ হয়ে সংসারের চাপে ওই মক্তবেই এক বছর শিক্ষকতা করেন। বারো বছর বয়সে লেটো গানের দলে যোগদান করে পালাগান রচনার মধ্য দিয়ে তাঁর কবিপ্রতিভার স্ফুরণ ঘটে।
শিক্ষা ও পেশা: নজরুলের শিক্ষাজীবন বারবার বাধাগ্রস্থ হয়। তিনি বর্ধমানে ও পরে ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার দরিরামপুর হাইস্কুলে লেখাপড়া করেন। ১৯৭১ সালে সেনাবাহিনীর বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে করাচি যান। সেখানেই তিনি সাহিত্যচর্চা শুরু করেন।
সাহিত্যিক পরিচয়: কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাধর ব্যক্তি। সাহিত্যের বিচিত্র ক্ষেত্রে তাঁর ছিল বিস্ময়কর পদচারণা। তাঁর লেখায় তিনি সামাজিক অবিচার ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। বাংলা সাহিত্য জগতে তাঁর আবির্ভাব এক নতুন দিগন্তও উন্মেচন করে। আরবি-ফারসি শব্দের সার্থক ব্যবহার তাঁর কবিতাকে বিশিষ্টতা দান করেছে।
উল্লেখযোগ্য রচনা
কাব্যগ্রন্থ : অগ্নি-বীণা, বিষের বাঁশি, ছায়াটন, প্রলয়শিখা, চক্রবাক, সিন্ধুহিন্দোল।
উপস্যাস : বাঁধনহারা, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা।
গল্পগ্রন্থ : ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, শিউলিমালা।
প্রবন্ধগ্রন্থ : যুগবাণী, দুর্দিনের যাত্রী, রাজবন্দীর জবানবন্দি।
পুরস্কার ও সম্মাননা: স্বাধীনতার পর কাজী নজরুল ইসলামকে ঢাকায় এনে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে জাতীয় কবির মর্যাদা প্রদান করা হয়। এছাড়া তিনি ভারত সরকারের থেকে “পদ্মভূষণ” উপাধি লাভ করেন। তাঁর অসাধারণ সাহিত্য-কীর্তির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি.লিট. উপাধি প্রদান করেন।
উপাধি: বিদ্রোহী কবি।
ব্যাধি ও মৃত্যু: নজরুল মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে বাক্শক্তি হারায়। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর অসুস্থ কবিকে ঢাকায় এনে চিকিৎসা করানো হয়। তিনি ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে ২ শে আগস্ট, বাংলা ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ই ভাদ্র ঢাকায় মসজিদ সংলগ্ন প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়।
তিমির রাত্রি-'এশা'র আজান শুনি দূর মসজিদে।
প্রিয়-হারা কার কান্নার মত 🔒ব্যাখ্যা এ-বুকে আসিয়া বিধে !
আমির-উল-মুমেনিন,🔒ব্যাখ্যা
তোমার স্মৃতি যে আজানের ধ্বনি জানে না মুয়াজ্জিন। 🔒ব্যাখ্যা
তকবির শুনি, শয্যা ছাড়িয়া চকিতে উঠিয়া বসি,
বাতায়নে চাই-উঠিয়াছে কি-রে গগনে মরুর শশী?
ও-আজান, ও কি পাপিয়ার ডাক, ও কি চকোরীর গান?
মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ও কি ও তোমারি সে আহ্বান?
আবার লুটায়ে পড়ি।
"সেদিন গিয়াছে"-শিয়রের কাছে কহিছে কালের ঘড়ি। 🔒ব্যাখ্যা
উমর! ফারুক! আখেরী নবির ওগো দক্ষিণ-বাহু!
আহ্বান নয় - রূপ ধরে এস - গ্রাসে অন্ধতা - রাহু!
ইসলাম-রবি, জ্যোতি তার আজ দিনে দিনে বিমলিন!
সত্যের আলো নিভিয়া-জ্বলিছে জোনাকির আলো ক্ষীণ!
শুধু আঙ্গুলি-হেলনে শাসন করিতে এ জগতের
দিয়াছিলে ফেলি মুহম্মদের চরণে যে-শমশের
ফিরদৌস ছাড়ি নেমে এস তুমি সেই শমশের ধরি
আর একবার লোহিত-সাগরে লালে-লাল হয়ে মরি!
ইসলাম-সে তো পরশ-মানিক তাকে কে পেয়েছে খুঁজি? 🔒ব্যাখ্যা
পরশে তাহার সোনা হল যারা তাদেরেই মোরা বুঝি।
আজ বুঝি-কেন বলিয়াছিলেন শেষ পয়গম্বর-
মোর পরে যদি নবি হত কেউ, হত সে এক উমর।' 🔒ব্যাখ্যা
************************************
অর্ধ পৃথিবী করেছ শাসন ধূলার তখতে বসি 🔒ব্যাখ্যা
খেজুর পাতার প্রাসাদ তোমার বারে বারে গেছে খসি
সাইমুম-ঝড়ে। পড়েছে কুটির, তুমি পড়নি ক'নুয়ে,🔒ব্যাখ্যা
ঊর্ধ্বের যারা-পড়েছে তাহারা, তুমি ছিলে খাড়া ভুঁয়ে ।
শত প্রলোভন বিলাস বাসনা ঐশ্বর্যের মদ
করেছে সালাম দূর হতে সব ছুঁইতে পারেনি পদ।
সবারে উর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়া তুমি ছিলে সব নিচে, 🔒ব্যাখ্যা
বুকে করে সবে বেড়া করি পার, আপনি রহিলে পিছে।
হেরি পশ্চাতে চাহি-
তুমি চলিয়াছ রোদ্রদগ্ধ দূর মরুপথ বাহি
জেরুজালেমের কিল্লা যথায় আছে অবরোধ করি
বীর মুসলিম সেনাদল তব বহু দিন মাস ধরি।
দুর্গের দ্বার খুলিবে তাহারা বলেছে শত্রু শেষে-
উমর যদি গো সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করে এসে!
হায় রে, আধেক ধরার মালিক আমির-উল-মুমেনিন
শুনে সে খবর একাকী উষ্ট্রে চলেছে বিরামহীন
সাহারা পারায়ে! ঝুলিতে দু খানা শুকনো 'খবুজ' রুটি
একটি মশকে একটুকু পানি খোর্মা দু তিন মুঠি।
প্রহরীবিহীন সম্রাট চলে একা পথে উটে চড়ি
চলেছে একটি মাত্র ভৃত্য উষ্ট্রের রশি ধরি !
মরুর সূর্য ঊর্ধ্ব আকাশে আগুন বৃষ্টি করে,
সে আগুন-তাতে খই সম ফোটে বালুকা মরুর পরে।
কিছুদুর যেতে উট হতে নামি কহিলে ভৃত্যে, "ভাই
পেরেশান বড় হয়েছ চলিয়া! এইবার আমি যাই
উষ্ট্রের রশি ধরিয়া অগ্রে,🔒ব্যাখ্যা তুমি উঠে বস উটে,
তপ্ত বালুতে চলি যে চরণে রক্ত উঠেছে ফুটে ।"
…ভৃত্য হস্ত চুমি
কাঁদিয়া কহিল, 'উমর। কেমনে এ আদেশ কর তুমি?
উষ্ট্রের পিঠে আরাম করিয়া গোলাম রহিবে বসি
আর হেঁটে যাবে খলিফা উমর ধরি সে উটের রশি?
খলিফা হাসিয়া বলে,
'তুমি জিতে গিয়ে বড় হতে চাও, ভাই রে, এমনি ছলে।
রোজ-কিয়ামতে আল্লাহ যে দিন কহিবে, 'উমর! ওরে
করে নি খলিফা, মুসলিম-জাঁহা তোর সুখ তরে তোরে।'
কী দিব জওয়াব কী করিয়া মুখ দেখাব রসুলে ভাই।
আমি তোমাদের প্রতিনিধি শুধু। মোর অধিকার নাই। 🔒ব্যাখ্যা
আরাম সুখের, - মানুষ হইয়া নিতে মানুষের সেবা।
ইসলাম বলে, সকলে সমান, কে বড় ক্ষুদ্র কেবা। 🔒ব্যাখ্যা
ভৃত্য চড়িল উটের পৃষ্ঠে উমর ধরিল রশি, 🔒ব্যাখ্যা
মানুষেরে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধুলায় নামিল শশী। 🔒ব্যাখ্যা
জানি না, সেদিন আকাশে পুষ্প বৃষ্টি হইল কিনা,
কী গান গাহিল মানুষে সেদিন বন্দি' বিশ্ববীণা।
জানি না, সেদিন ফেরেশতা তব করেছে কি না স্তব-
অনাগত কাল গেয়েছিল শুধু, 'জয় জয় হে মানব।'
**************************************
তুমি নির্ভীক, এক খোদা ছাড়া করনি ক' কারে ভয়, 🔒ব্যাখ্যা
সত্যব্রত তোমায় তাইতে সবে উদ্ধত কয়।
মানুষ হইয়া মানুষের পূজা মানুষেরি অপমান,
তাই মহাবীর খালেদেরে তুমি পাঠাইলে ফরমান,
সিপাহ-সালারে, ইঙ্গিতে তব করিলে মামুলি সেনা,
বিশ্ব-বিজয়ী বীরেরে শাসিতে এতটুকু টলিলে না।
************************************
মানব-প্রেমিক! আজিকে তোমারে স্মরি, 🔒ব্যাখ্যা
মনে পড়ে তব মহত্ত্ব-কথা-সেদিন সে বিভাবরী
নগর-ভ্রমণে বাহিরিয়া তুমি দেখিতে পাইলে দূরে
মায়েরে ঘিরিয়া ক্ষুধাতুর দুটি শিশু সকরুণ সুরে
কাঁদিতেছে আর দুঃখিনী মাতা ছেলেরে ভুলাতে হায়,
উনানে শূন্য হাঁড়ি চড়াইয়া কাঁদিয়া অকূলে চায়।
শুনিয়া সকল-কাঁদিতে কাঁদিতে ছুটে গেলে মদিনাতে
বায়তুল-মাল হইতে লইয়া ঘৃত আটা নিজ হাতে,
বলিলে, 'এ সব চাপাইয়া দাও আমার পিঠের' পরে, 🔒ব্যাখ্যা
আমি লয়ে যাব বহিয়া এ-সব দুখিনী মায়ের ঘরে।'
কত লোক আসি আপনি চাহিল বহিতে তোমার বোঝা,
বলিলে, 'বন্ধু, আমার এ ভার আমিই বহিব সোজা। 🔒ব্যাখ্যা
রোজ-কিয়ামতে কে বহিবে বল আমার পাপের ভার?
মম অপরাধে ক্ষুধায় শিশুরা কাঁদিয়াছে, আজি তার
প্রায়শ্চিত্ত করিব আপনি'-চলিলে নিশীথ রাতে
পৃষ্ঠে বহিয়া খাদ্যের বোঝা দুখিনীর আঙিনাতে!
এত যে কোমল প্রাণ,
করুণার বশে তবু গো ন্যায়ের করনি কো অপমান!
মদ্যপানের অপরাধে প্রিয় পুত্রেরে নিজ করে
মেরেছ দোরা, মরেছে পুত্র তোমার চোখের পরে!
ক্ষমা চাহিয়াছে পুত্র, বলেছ পাষাণে বক্ষ বাঁধি-
'অপরাধ করে তোরি মত স্বরে কাঁদিয়াছে অপরাধী।'
আবু শাহমার 🔒ব্যাখ্যা গোরে
কাঁদিতে যাইয়া ফিরিয়া আসি গো তোমারে সালাম করে 🔒ব্যাখ্যা
খাস দরবার ভরিয়া গিয়াছে হাজার দেশের লোকে,
'কোথায় খলিফা' কেবলি প্রশ্ন ভাসে উৎসুক চোখে,
একটি মাত্র পিরান কাচিয়া শুকায়নি তাহা বলে,
রোদ্রে ধরিয়া বসিয়া আছে গো খলিফা আঙিনা-তলে।
হে খলিফাতুল-মুসলেমিন! হে চীরধারী সম্রাট!
অপমান তব করিব না আজ করিয়া নান্দী পাঠ, 🔒ব্যাখ্যা
মানুষেরে তুমি বলেছ বন্ধু, বলিয়াছ ভাই, তাই
তোমারে এমন চোখের পানিতে স্মরি গো সর্বদাই। 🔒ব্যাখ্যা
(সংক্ষেপিত)
শব্দার্থ ও টিকাঃ
উমর ফারুক- ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা। তাঁর খেলাফতের সময়কাল দশ বছর (৬৩৪-৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ)। তাঁর শাসনামলে ইসলামি রাষ্ট্রের সীমা আরব সাম্রাজ্য থেকে মিশর ও তুর্কিস্থানের সীমা পর্যন্ত প্রসারিত হয়। একজন ন্যায়নিষ্ঠ, নির্ভীক ও গণতন্ত্রমনা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁর খ্যাতি চির অম্লান। ‘ফারুক’ হযরত উমরের উপাধি। যিনি সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারেন তাঁকেই ‘ফারুক’ বলা হয়। হযরত উমর (রা.) ছিলেন সত্যের একজন দৃঢ়চিত্ত উপাসক ৷
‘তোমার স্মৃতি যে আযানের ধ্বনি জানে না মুয়াজ্জিন’- হযরত উমরের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পূর্বে নামাজের জন্য প্রকাশ্য আজান দেয়ার রীতি ছিল না। কোরেশদের ভয়ে মুসলমানরা উচ্চরবে আজান দিতে সাহস পেত না। উমর ছিলেন কোরেশ বংশোদ্ভূত শ্রেষ্ঠবীর । তিনি যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন, তখন প্রকাশ্যে আজান দিতে আর কোনো বাধা রইল না। তাই আজানের সঙ্গে যে উমরের স্মৃতি বিজড়িত সে কথা অনেক মুয়াজ্জিন জানে না ।
আবু শাহামা- হযরত উমরের পুত্র। মদপানের অপরাধে খলিফা তাকে ৮০টি বেত্রাঘাতের নির্দেশ দেন এবং নিজেই বেত্রাঘাত করেন। বেত্রাঘাতের ফলে আবু শাহমার মৃত্যু হয় ।