অপরিচিতা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 
 নাম : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
 ছন্দনাম : ভানুসিংহ।
 উপাধি : বিশ্বকবি।
 জন্ম : ১৮৬১ সালের মে মাসের ৭ তারিখে (২৫ বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দ)
 পিতা : মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
 পিতামহ : প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর।
 মাতা : সারদা দেবী।
 পরিবারের অবস্থান : বাবা মা’র চতুর্দশ সন্তান ও অষ্টমপুত্র।
 স্ত্রী : ভবতারিণী দেবী, পরিবর্তিত নাম মৃণালিনী দেবী।
 মৃত্যু : ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসের ৭ তারিখে (২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ।
সাহিত্যকর্ম 
রবীন্দ্রনাথের বিশাল সৃষ্টিভার: কাব্যগ্রন্থ- ৫৬; গীতিপুস্তক-৪; ছোটগল্প-১১৯; উপন্যাস-১২; ভ্রমণকাহিনী-৯; নাটক-২৯; কাব্যনাট্য-১৯; চিঠিপত্রের বই-১৩; গানের সংখ্যা-২২৩২ এবং অঙ্কিত চিত্রাবলি প্রায় দুইহাজার।
কাব্যগ্রন্থ: বলাকা, মানসী, জন্মদিন, নবজাতক, বনফুল, চৈতালী, চিত্রানদী, খেয়াপার, মহুয়া, পুনশ্চ, সোনারতরী, শ্যামলী, প্রভাত সঙ্গীত, সন্ধ্যা সঙ্গীত, স্বর্গ, পূরবী, বিচিত্রাময়, পত্রপুট, ভানুসিংহ, কনিকা, রোগশয্যায়, আরোগ্য, শেষ-লেখা, সানাই, কল্পনা, কড়ি ও কোমল ও গীতাঞ্জলী।
গল্পাকারে কাব্যগ্রন্থ মনে রাখার নিয়ম: মানসী তার বান্ধবীর মেয়ে বলাকার জন্মদিনে নবজাতকের জন্য বনফুল নিয়ে চৈতালী মাসে চিত্রানদীর খেয়াপার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। এসে দেখে সোনারতরীতে বসে মহুয়া এবং পুনশ্চ শ্যামলীর জন্য অপেক্ষা করছে। মনের সুখে প্রভাত সংগীত সন্ধা সংগীত সানাই এর সাথে গান গাইছে। হঠাৎ তখন স্বর্গ থেকে পূরবী এসে বিচিত্রাময় পত্রপুট দিয়ে বলল, এটি ভানুসিংহের মেয়ে কণিকাকে উৎসর্গ করলাম। পরবর্তীতে কল্পনা নিজ হাতে কড়ি ও কোমল নিয়ে প্রান্তিকভাবে শেষের লেখা গীতাঞ্জলী পাঠ করে সেজুঁতির জন্য রোগশয্যার আরগ্য লাভের জন্য প্রার্থনা করেন।
উপন্যাস: করুণা (সামাজিক), বৌ ঠাকুরানীর হাট (ঐতিহাসিক), রাজর্ষি (ঐতিহাসিক), চোখের বালি (মনস্তাত্তি¡ক), নৌকাডুবি (সামাজিক), গোরা (রাজনৈতিক), ঘরে বাইরে (রাজনৈতিক), চার অধ্যায় (রাজনৈতিক), চতুরঙ্গ (রোমান্টিক), যোগাযোগ (সামাজিক), দুইবোন (রোমাণ্টিক), মালঞ্চ (রোমাণ্টিক)।
গল্পাকারে মনে রাখার নিয়ম: করুণা করে আমাকে বউ ঠাকুরানীর হাটে, পৌঁছে দিও, সেখানে হয়ত রাজর্ষি’কে খুঁজে পাবো। আগামী বছর তার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নৌকাডুবির ফলে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এখন আমি তার চোখের বালি। আমার দুইবোন এবং ভাই গৌরাকে খুঁজেছি পাইনি। অবশেষে জীবনের চার অধ্যায় পেরিয়ে চতুরঙ্গের কষাঘাতে মালঞ্চে বসে লেখি শেষের কবিতা।
নাট্যগ্রন্থ: ফাল্গুনী, বিসর্জন, গোড়ায় গলদ, রাজা (১৯১০), অচলায়তন (১৯১২), চিরকুমার, সভা, অরূপরতন, তাপসী, ডাকঘর (১৯১২), তাসের দেশ (১৯১৩), রক্তকরবী (১৯১৪), মুক্তধারা, মুকুট, কালের যাত্রা, গৃহ প্রবেশ, পরিত্রাণ, তপতী (১৯২৯), বাঁশরী (১৯৩৩)।
গল্পে গল্পে মনে রাখার নিয়ম: রক্তকরবী বাঁশরী হতে তাসের ঘর থেকে বেরিয়ে সভা ডাকল চিরকুমার মুক্তধারা গ্রামের ডাকঘরে। সভায় রাজা তাঁর অচলায়তনের বন্ধু তপতী ও মালিনীকে নিয়ে হাজির হলে চিরকুমারের মন ভেঙ্গে যায়। রাজা বলল, আমি অপরূপরতন গোড়ায় গলদ থাকার কারণে চিরকুমারের মুকুট পরিত্রাণ করে কালের যাত্রায় যায়। সেখানে চিত্রাঙ্গদাকে বিয়ে করি। একথা শুনে সভার একমাত্র চাকরাণী ফাল্গুনী রাজার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিল।
ছোটগল্প: তিন সঙ্গী ( ১৯৪১), আড্ডা, গল্পসল্প (১৯৪১), গল্পগুচ্ছ।
গল্পে গল্পে মনে রাখার নিয়ম: রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের চারটি খণ্ড থেকে ছোট গল্পসল্প নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে তিন সঙ্গী।
জীবন কথা: পথের সঞ্চয়, জীবন স্মৃতি, ছেলেবেলা।
গল্পে গল্পে মনে রাখার নিয়ম: ছেলেবেলার স্মৃতি পথ চলতে মনে পড়ে যায়।
ভ্রমণ কাহিনি : জাপানযাত্রী, পথের সঞ্চয়, পারস্য, রাশিয়ার চিঠি, য়ুরোপযাত্রীর ডায়েরী, য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র প্রভৃতি।
গল্পে গল্পে মনে রাখার নিয়ম: জাপানের যাত্রীরা রাশিয়ার চিঠি পড়ে ইউরোপ সম্পর্কে জানতে পারল।
রবীন্দ্রনাথে প্রথম রচনাসমূহ 
 প্রথম সম্পাদিত পত্রিকা : সাধনা (মাসিক, ১৮৯৪)।
 প্রথম কাব্য : বনফুল (প্রকাশিত ১৮৭৬)।
 প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : কবিকাহিনী (১৮৭৮)।
 প্রথম উপন্যাস : করুণা (১৮৭৭ ভারতীয় প্রত্রিকায় প্রকাশিত হয়)
 প্রথম সার্থক উপন্যাস : বৌ ঠাকুরানীর হাট (১৮৮৩)। 
 প্রথম কবিতা : হিন্দুমেলার উপহার।
 প্রথম ছোট গল্প : ভিখারিণী (১৮৮১)।প্রথম প্রকাশিত 
নাটক : রুদ্রচণ্ড (১৮৮১)।
নোবেল পুরস্কার লাভ : ১৯১৩ সালে। ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের    ইংরেজি অনুবাদ ‘song offerings’ নামে।
 নাইট উপাধি লাভ : ১৯১৫ সালে।
নাইট উপাধি ত্যাগ : ১৯১৯ সালে। ইংরেজ কর্তৃক পাঞ্জাবের অমৃতসরে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে।
রবীন্দ্রনাথ উৎসর্গকৃত গ্রন্থ 
বসন্ত- নজরুলকে।
তাসেরদেশ- নেতাজী সুভাষ চন্দ্রবসুকে।
চার অধ্যায়- বৃটিশ সরকারের রাজবন্দীকে।
কালের যাত্রা- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
উৎস পরিচিতি 
‘অপরিচিতা’ প্রথম প্রকাশিত হয় প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত মাসিক ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার ১৩২১ বঙ্গাব্দের (১৯১৪) কার্তিক সংখ্যায়। এটি প্রথম গ্রন্থভুক্ত হয় বরীন্দ্রনাথের সংকলন ‘গল্পসপ্তক’ এ এবং পরে, ‘গল্পগুচ্ছ’ তৃতীয় খণ্ডে (১৯২৭)। ‘অপরিচিতা’ উত্তম পুরুষের জবানিতে লেখা গল্প।
ভাষারীতি 
‘অপরিচিতা’ প্রবন্ধটি সাধুরীতিতে লেখা হয়েছে।
প্রথম ও শেষ লাইন 
প্রথম লাইন - আজ আমা বয়স সাতাশ মাত্র।
শেষ লাইন - ওগো অপরিচিতা, তোমার পরিচয়ের শেষ হইল না, শেষ হইবে না; কিন্তু ভাগ্য আমার ভালো, এই তো আমি জায়গা পাইয়াছি।





অপরিচিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আজ আমার বয়স সাতাশ মাত্র। এ জীবনটা না দৈর্ঘ্যের হিসাবে বড়, না গুণের হিসাবে 🔒ব্যাখ্যা। তবু ইহার একটু বিশেষ মূল্য আছে। ইহা সেই ফুলের মতো যাহার বুকের উপরে ভ্রমর আসিয়া বসিয়াছিল, এবং সেই পদক্ষেপের ইতিহাস তাহার জীবনের মাঝখানে ফলের মতো গুটি ধরিয়া উঠিয়াছে।

সেই ইতিহাসটুকু আকারে ছোটো, তাহাকে ছোটো করিয়াই লিখিব। ছোটোকে যাঁহারা সামান্য বলিয়া ভুল করেন না তাঁহারা ইহার রস বুঝিবেন। 🔒ব্যাখ্যা

কলেজে যতগুলো পরীক্ষা পাস করিবার সব আমি চুকাইয়াছি। ছেলেবেলায় আমার সুন্দর চেহারা লইয়া পণ্ডিতমশায় আমাকে শিমুল ফুল ও মাকাল ফলের সহিত তুলনা করিয়া বিদ্রূপ করিবার সুযোগ পাইয়াছিলেন। 🔒ব্যাখ্যা ইহাতে তখন বড়ো লজ্জা পাইতাম; কিন্তু বয়স হইয়া এ কথা ভাবিয়াছি, যদি জন্মান্তর থাকে তবে আমার মুখে সুরূপ এবং পণ্ডিতমশায়দের মুখে বিদ্রূপ আবার যেন এমনি করিয়াই প্রকাশ পায়। 🔒ব্যাখ্যা

আমার পিতা এক কালে গরিব ছিলেন। ওকালতি করিয়া তিনি প্রচুর টাকা রোজগার করিয়াছেন, ভোগ করিবার সময় নিমেষমাত্রও পান নাই। মৃত্যুতে তিনি যে হাঁফ ছাড়িলেন সেই তাঁর প্রথম অবকাশ। 🔒ব্যাখ্যা

আমার তখন বয়স অল্প। মার হাতেই আমি মানুষ। মা গরিবের ঘরের মেয়ে; তাই, আমরা যে ধনী এ কথা তিনিও ভোলেন না, আমাকে ভুলিতে দেন না। 🔒ব্যাখ্যা শিশুকালে আমি কোলে কোলেই মানুষ 🔒ব্যাখ্যা— বোধ করি, সেইজন্য শেষ পর্যন্ত আমার পুরাপুরি বয়সই হইল না। 🔒ব্যাখ্যা আজও আমাকে দেখিলে মনে হইবে, আমি অন্নপূর্ণার কোলে গজাননের ছোটো ভাইটি। 🔒ব্যাখ্যা

আমার আসল অভিভাবক আমার মামা। 🔒ব্যাখ্যা তিনি আমার চেয়ে বড়োজোর বছর ছয়েক বড়ো। কিন্তু, ফল্গুর বালির মতো তিনি আমাদের সমস্ত সংসারটাকে নিজের অন্তরের মধ্যে শুষিয়া লইয়াছেন। 🔒ব্যাখ্যা তাঁহাকে না খুঁড়িয়া এখানকার এক গণ্ডূষও রস পাইবার জো নাই। 🔒ব্যাখ্যা এই কারণে কোনো-কিছুর জন্যই আমাকে কোনো ভাবনা ভাবিতেই হয় না। 🔒ব্যাখ্যা

কন্যার পিতা মাত্রেই স্বীকার করিবেন, আমি সৎপাত্র। 🔒ব্যাখ্যা তামাকটুকু পর্যন্ত খাই না। ভালোমানুষ হওয়ার কোনো ঝঞ্ঝাট নাই, 🔒ব্যাখ্যা তাই আমি নিতান্ত ভালোমানুষ। মাতার আদেশ মানিয়া চলিবার ক্ষমতা আমার আছে— বস্তুত, না মানিবার ক্ষমতা আমার নাই। 🔒ব্যাখ্যা অন্তঃপুরের শাসনে চলিবার মতো করিয়াই আমি প্রস্তুত হইয়াছি, যদি কোনো কন্যা স্বয়ম্বরা হন তবে এই সুলক্ষণটি স্মরণ রাখিবেন।

অনেক বড়ো ঘর হইতে আমার সম্বন্ধ আসিয়াছিল। কিন্তু মামা, যিনি পৃথিবীতে আমার ভাগ্যদেবতার প্রধান এজেন্ট , 🔒ব্যাখ্যা বিবাহ সম্বন্ধে তাঁর একটা বিশেষ মত ছিল। ধনীর কন্যা তাঁর পছন্দ নয়। আমাদের ঘরে যে মেয়ে আসিবে সে মাথা হেঁট করিয়া আসিবে, এই তিনি চান। অথচ টাকার প্রতি আসক্তি তাঁর অস্থিমজ্জায় জড়িত। 🔒ব্যাখ্যা তিনি এমন বেহাই চান যাহার টাকা নাই অথচ যে টাকা দিতে কসুর করিবে না। 🔒ব্যাখ্যা যাহাকে শোষণ করা চলিবে অথচ বাড়িতে আসিলে গুড়গুড়ি পরিবর্তে বাঁধা হুঁকায় তামাক দিলে যাহার নালিশ খাটিবে না।

আমার বন্ধু হরিশ কানপুরে কাজ করে। সে ছুটিতে কলিকাতায় আসিয়া আমার মন উতলা করিয়া দিল। 🔒ব্যাখ্যা সে বলিল, “ওহে, মেয়ে যদি বল একটি খাসা মেয়ে আছে।” 🔒ব্যাখ্যা

কিছুদিন পূর্বেই এমএ পাস করিয়াছি। সামনে যত দূর পর্যন্ত দৃষ্টি চলে ছুটি ধূ ধূ করিতেছে; পরীক্ষা নাই, উমেদারি নাই, চাকরি নাই; নিজের বিষয় দেখিবার চিন্তাও নাই, শিক্ষাও নাই, ইচ্ছাও নাই— থাকিবার মধ্যে ভিতরে আছেন মা এবং বাহিরে আছেন মামা।

এই অবকাশের মরুভূমির মধ্যে আমার হৃদয় তখন বিশ্বব্যাপী নারীরূপের মরীচিকা দেখিতেছিল— আকাশে তাহার দৃষ্টি, বাতাসে তাহার নিঃশ্বাস, তরুমর্মরে তাহার গোপন কথা। 🔒ব্যাখ্যা

এমন সময় হরিশ আসিয়া বলিল, “মেয়ে যদি বল, তবে—” । আমার শরীর-মন বসন্তবাতাসে বকুলবনের নবপল্লবরাশির মতো কাঁপিতে কাঁপিতে আলোছায়া বুনিতে লাগিল। 🔒ব্যাখ্যা হরিশ মানুষটা ছিল রসিক, রস দিয়া বর্ণনা করিবার শক্তি তাহার ছিল, আর আমার মন ছিল তৃষার্ত।

আমি হরিশকে বলিলাম, “একবার মামার কাছে কথাটা পাড়িয়া দেখো।”

হরিশ আসর জমাইতে অদ্বিতীয়। তাই সবত্রই তাহার খাতির। 🔒ব্যাখ্যা মামাও তাহাকে পাইলে ছাড়িতে চান না। 🔒ব্যাখ্যা কথাটা তাঁর বৈঠকে উঠিল। মেয়ের চেয়ে মেয়ের বাপের খবরটাই তাঁহার কাছে গুরুতর। 🔒ব্যাখ্যা বাপের অবস্থা তিনি যেমনটি চান তেমনি। এক কালে ইহাদের বংশে লক্ষ্মীর মঙ্গলঘট ভরা ছিল। 🔒ব্যাখ্যা এখন তাহা শূন্য বলিলেই হয়, অথচ তলায় সামান্য কিছু বাকি আছে। দেশে বংশমর্যাদা রাখিয়া চলা সহজ নয় বলিয়া ইনি পশ্চিমে গিয়া বাস করিতেছেন। 🔒ব্যাখ্যা সেখানে গরিব গৃহস্থের মতোই থাকেন। একটি মেয়ে ছাড়া তাঁর আর নাই। সুতরাং তাহারই পশ্চাতে লক্ষ্মীর ঘটটি একবারে উপুড় করিয়া দিতে দ্বিধা হইবে না।

এসব ভালো কথা। কিন্তু, মেয়ের বয়স যে পনেরো, তাই শুনিয়া মামার মন ভার হইল। 🔒ব্যাখ্যা বংশে তো কোনো দোষ নাই? 🔒ব্যাখ্যা না, দোষ নাই— বাপ কোথাও তাঁর মেয়ের যোগ্য বর খুঁজিয়া পান না। একে তো বরের হাট মহার্ঘ, তাহার পরে ধনুক-ভাঙা পণ, কাজেই বাপ কেবলই সবুর করিতেছেন- কিন্তু মেয়ের বয়স সবুর করিতেছে না।

যাই হোক, হরিশের সরস রসনার গুণ আছে। 🔒ব্যাখ্যা মামার মন নরম হইল। 🔒ব্যাখ্যা বিবাহের ভূমিকা-অংশটা নির্বিঘ্নে সমাধা হইয়া গেল। 🔒ব্যাখ্যা কলিকাতার বাহিরে বাকি যে পৃথিবীটা আছে সমস্তটাকেই মামা আন্ডামান দ্বীপের অন্তর্গত বলিয়া জানেন। জীবনে একবার বিশেষ কাজে তিনি কোন্নগর পর্যন্ত গিয়েছিলেন। মামা যদি মনু হইতেন তবে তিনি হাবড়ার পুল পার হওয়াটাকে তাঁহার সংহিতায় একেবারে নিষেধ করিয়া দিতেন। মনের মধ্যে ইচ্ছা ছিল, নিজের চোখে মেয়ে দেখিয়া আসিব। সাহস করিয়া প্রস্তাব করিতে পারিলাম না। 🔒ব্যাখ্যা

কন্যাকে আশীর্বাদ করিবার জন্য যাহাকে পাঠানো হইল সে আমাদের বিনুদাদা, আমার পিসততো ভাই। তাহার মত, রুচি এবং দক্ষতার ’পরে আমি ষোল-আনা নির্ভর করিতে পারি। বিনুদা ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, “মন্দ নয় হে ! খাঁটি সোনা বটে !” 🔒ব্যাখ্যা

বিনুদাদার ভাষাটা অত্যন্ত আঁট। যেখানে আমরা বলি ‘চমৎকার’ সেখানে তিনি বলেন ‘চলনসই’। অতএব বুঝিলাম, আমরা ভাগ্যে প্রজাপতির সঙ্গে পঞ্চশরের কোনো বিরোধ নাই।  🔒ব্যাখ্যা

বলা বাহুল্য, বিবাহ-উপলক্ষে কন্যাপক্ষকেই কলিকাতায় আসিতে হইল। কন্যার পিতা শম্ভুনাথবাবু হরিশকে কত বিশ্বাস করেন তাহার প্রমাণ এই যে, বিবাহের তিন দিন পূর্বে তিনি আমাকে প্রথম চক্ষে দেখেন এবং আশীর্বাদ করিয়া যান। বয়স তাঁর চল্লিশের কিছু এপারে বা ওপারে। চুল কাঁচা, গোঁফে পাক ধরিতে আরম্ভ করিয়াছে মাত্র। সুপুরুষ বটে। ভিড়ের মধ্যে দেখিলে সকলের আগে তাঁর উপরে চোখ পড়িবার মতো চেহারা। 🔒ব্যাখ্যা

আশা করি আমাকে দেখিয়া তিনি খুশি হইয়াছিলেন। বোঝা শক্ত, কেননা তিনি বড়ই চুপচাপ। যে দুটি-একটি কথা বলেন যেন তাহাতে পুরা জোর দিয়া বলেন না। মামার মুখ তখন অনর্গল ছুটিতেছিল— ধনে মানে আমাদের স্থান যে শহরের কারো চেয়ে কম নয়, সেইটেকেই তিনি নানা প্রসঙ্গে প্রচার করিতেছিলেন। শম্ভুনাথবাবু এ কথায় একেবারে যোগই দিলেন না— কোনো ফাঁকে একটা হুঁ বা হ্যাঁ কিছুই শোনা গেল না। আমি হইলে দমিয়া যাইতাম, কিন্তু মামাকে দমানো শক্ত। তিনি শম্ভুনাথবাবুর চুপচাপ ভাব দেখিয়া ভাবিলেন, লোকটা নিতান্ত নির্জীব, একেবারে কোনো তেজ নাই। বেহাই-সম্প্রদায়ের আর যাই থাক, তেজ থাকাটা দোষের, 🔒ব্যাখ্যা অতএব মামা মনে মনে খুশি হইলেন। 🔒ব্যাখ্যা শম্ভুনাথবাবু যখন উঠিলেন তখন মামা সংক্ষেপে উপর হইতেই তাঁকে বিদায় করিলেন, গাড়িতে তুলিয়া দিতে গেলেন না।
পণ সম্বন্ধে দুই পক্ষে পাকাপাকি কথা ঠিক হইয়া গিয়াছিল। মামা নিজেকে অসামান্য চতুর বলিয়াই অভিমান করিয়া থাকেন। কথাবার্তায় কোথাও তিনি কিছু ফাঁক রাখেন নাই। টাকার অঙ্ক তো স্থির ছিলই, তারপরে গহনা কত ভরির এবং সোনা কত দরের হইবে সেও একেবারে বাঁধাবাঁধি হইয়া গিয়াছিল। আমি নিজে এসমস্ত কথার মধ্যে ছিলাম না; জানিতাম না দেনা-পাওনা কী স্থির হইল। মনে জানিতাম, এই স্থূল অংশটাও বিবাহের একটা প্রধান অংশ, 🔒ব্যাখ্যা এবং সে অংশের ভার যার উপরে তিনি এক কড়াও ঠকিবেন না। বস্তুত, আশ্চর্য পাকা লোক বলিয়া মামা আমাদের সমস্ত সংসারের প্রধান গর্বের সামগ্রী। যেখানে আমাদের কোনো সম্বন্ধ আছে সেখানে সর্বত্রই তিনি বুদ্ধির লড়াইয়ে জিতিবেন, এ একেবারে ধরা কথা। এই জন্য আমাদের অভাব না থাকিলেও এবং অন্য পক্ষের অভাব কঠিন হইলেও জিতিব, আমাদের সংসারের এই জেদ— ইহাতে যে বাঁচুক আর যে মরুক। 🔒ব্যাখ্যা

গায়ে-হলুদ অসম্ভব রকম ধুম করিয়া গেল। বাহক এত গেল যে তাহার আদম-শুমারি করিতে হইলে কেরানি রাখিতে হয়। তাহাদিগকে বিদায় করিতে অপর পক্ষকে যে নাকাল হইতে হইবে, 🔒ব্যাখ্যা সেই কথা স্মরণ করিয়া মামার সঙ্গে মা একযোগে বিস্তর হাসিলেন।

ব্যান্ড, বাঁশি, শখের কন্সর্ট প্রভৃতি যেখানে যতপ্রকার উচ্চ শব্দ আছে সমস্ত একসঙ্গে মিশাইয়া বর্বর কোলাহলের মত্ত হস্তী দ্বারা সংগীত সরস্বতীর পদ্মবন দলিত বিদলিত করিয়া আমি তো বিবাহ-বাড়িতে গিয়া উঠিলাম। আংটিতে হারেতে জরি-জহরতে আমার শরীর যেন গহনার দোকান নিলামে চড়িয়াছে বলিয়া বোধ হইল। তাঁহাদের ভাবী জামাইয়ের মূল্য কত সেটা যেন কতক পরিমাণে সর্বাঙ্গে স্পষ্ট করিয়া লিখিয়া ভাবী শ্বশুরের সঙ্গে মোকাবিলা করিতে চলিয়াছিলাম।

মামা বিবাহ-বাড়িতে ঢুকিয়া খুশি হইলেন না। 🔒ব্যাখ্যা একে তো উঠানটাতে বরযাত্রীদের জায়গা সংকুলান হওয়াই শক্ত, তাহার পরে সমস্ত আয়োজন নিতান্ত মধ্যম রকমের। ইহার পরে শম্ভুনাথবাবুর ব্যবহারটাও নেহাত ঠাণ্ডা। তাঁর বিনয়টা অজস্র নয়। মুখে তো কথাই নাই কোমরে চাদর বাঁধা, গলা ভাঙা, টাক-পড়া, মিশ-কালো এবং বিপুল-শরীর তাঁর একটি উকিল-বন্ধু যদি নিয়ত হাত জোড় করিয়া মাথা হেলাইয়া, নম্রতার স্মিতহাস্যে ও গদগদ বচনে কন্সর্ট পার্টির করতাল-বাজিয়ে হইতে শুরু করিয়া বরকর্তাদের প্রত্যেককে বার বার প্রচুররূপে অভিষিক্ত করিয়া না দিতেন তবে গোড়াতেই এটা এস্‌পার-ওসপার হইত। 🔒ব্যাখ্যা

আমি সভায় বসিবার কিছুক্ষণ পরেই মামা শম্ভুনাথবাবুকে পাশের ঘরে ডাকিয়া লইয়া গেলেন। 🔒ব্যাখ্যা কী কথা হইল জানি না, কিছুক্ষণ পরেই শম্ভুনাথবাবু আমাকে আসিয়া বলিলেন, “বাবাজি, একবার এই দিকে আসতে হচ্ছে।”

ব্যাপারখানা এই।– সকলের না হউক, কিন্তু কোনো কোনো মানুষের জীবনের একটা কিছু লক্ষ্য থাকে। মামার একমাত্র লক্ষ্য ছিল, তিনি কোনোমতেই কারও কাছে ঠকিবেন না। তাঁর ভয় তাঁর বেহাই তাঁকে গহনায় ফাঁকি দিতে পারেন— বিবাহকার্য শেষ হইয়া গেলে সে ফাঁকির আর প্রতিকার চলিবে না। বাড়িভাড়া সওগাদ লোক-বিদায় প্রভৃতি সম্বন্ধে যেরকম টানাটানির পরিচয় পাওয়া গেছে তাহাতে মামা ঠিক করিয়াছিলেন দেওয়া-থোওয়া সম্বন্ধে এ লোকটির শুধু মুখের কথার উপর ভর করা চলিবে না। সেইজন্য বাড়ির  সেকরাকে সুদ্ধ সঙ্গে আনিয়াছিলেন। 🔒ব্যাখ্যা পাশের ঘরে গিয়া দেখিলাম, মামা এক তক্তপোশে এবং সেকরা তাহার দাঁড়িপাল্লা কষ্টিপাথর প্রভৃতি লইয়া মেঝেয় বসিয়া আছে। 🔒ব্যাখ্যা

শম্ভুনাথবাবু আমাকে বলিলেন, “তোমার মামা বলিতেছেন বিবাহের কাজ শুরু হইবার আগেই তিনি কনের সমস্ত গহনা যাচাই করিয়া দেখিবেন,  ইহাতে তুমি কী বল।” 

আমি মাথা হেঁট করিয়া চুপ করিয়া রহিলাম।

মামা বলিলেন, “ও আবার কী বলিবে। আমি যা বলিব তাই হইবে।”

শম্ভুনাথবাবু আমার দিকে চাহিয়া কহিলেন, “সেই কথা তবে ঠিক? উনি যা বলিবেন তাই হইবে? এ সম্বন্ধে তোমার কিছুই বলিবার নাই? ”

আমি একটু ঘাড়-নাড়ার ইঙ্গিতে জানাইলাম, এসব কথায় আমার সম্পূর্ণ অনধিকার। 

“আচ্ছা তবে বোসো, মেয়ের গা হইতে সমস্ত গহনা খুলিয়া আনিতেছি।” 🔒ব্যাখ্যা এই বলিয়া তিনি উঠিলেন।

মামা বলিলেন, “অনুপম এখানে কী করিবে। ও সভায় গিয়া বসুক।”

শম্ভুনাথ বলিলেন, “না, সভায় নয়, এখানেই বসিতে হইবে।”

কিছুক্ষণ পরে তিনি একখানা গামছায় বাঁধা গহনা আনিয়া তক্তপোশের উপর মেলিয়া ধরিলেন। সমস্তই তাঁহার পিতামহীদের আমলের গহনা— হাল ফ্যাশানের সূক্ষ্ম কাজ নয়— যেমন মোটা, তেমনি ভারী।

সেকরা গহনা হাতে তুলিয়া লইয়া বলিল, “এ আর দেখিব কী। ইহাতে খাদ নাই— এমন সোনা এখনকার দিনে ব্যবহারই হয় না।”

এই বলিয়া সে মকরমুখা মোটা একখানা বালায় একটু চাপ দিয়া দেখাইল তাহা বাঁকিয়া যায়।

মামা তখনই তাঁর নোটবইয়ে গহনাগুলির ফর্দ টুকিয়া লইলেন, পাছে যাহা দেখানো হইল তাহার কোনোটা কম পড়ে। হিসাব করিয়া দেখিলেন, গহনা যে পরিমাণ দিবার কথা এগুলি সংখ্যায়, দরে এবং ভারে তার অনেক বেশি।

গহনাগুলির মধ্যে একজোড়া এয়ারিং ছিল। শম্ভুনাথ সেইটে সেকরার হাতে দিয়া বলিলেন, “এইটে একবার পরখ করিয়া দেখো।”

সেকরা কহিল, “ইহা বিলাতি মাল, ইহাতে সোনার ভাগ সামান্যই আছে।”

শম্ভুবাবু এয়ারিংজোড়া মামার হাতে দিয়া বলিলেন, “এটা আপনারাই রাখিয়া দিন।”

মামা সেটা হাতে লইয়া দেখিলেন, এই এয়ারিং দিয়াই কন্যাকে তাঁহারা আশীর্বাদ করিয়াছিলেন।

মামার মুখ লাল হইয়া উঠিল। 🔒ব্যাখ্যা দরিদ্র তাঁহাকে ঠকাইতে চাহিবে কিন্তু তিনি ঠকিবেন না এই আনন্দ-সম্ভোগ হইতে বঞ্চিত হইলেন এবং তাহার উপরেও কিছু উপরি-পাওনা জুটিল। অত্যন্ত মুখ ভার করিয়া বলিলেন, “অনুপম, যাও তুমি সভায় গিয়া বোসো গে।”

শম্ভুনাথবাবু বলিলেন, “না, এখন সভায় বসিতে হইবে না। চলুন, আগে আপনাদের খাওয়াইয়া দিই।”

মামা বলিলেন, “সে কী কথা। লগ্ন—”

শম্ভুনাথবাবু বলিলেন, “সেজন্য কিছু ভাবিবেন না— এখন উঠুন।”

লোকটি নেহাত ভালোমানুষ-ধরনের কিন্তু ভিতরে বেশ একটু জোর আছে বলিয়া বোধ হইল। মামাকে উঠিতে হইল। বরযাত্রীদেরও আহার হইয়া গেল। আয়োজনের আড়ম্বর ছিল না। 🔒ব্যাখ্যা কিন্তু রান্না ভালো এবং সমস্ত বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বলিয়া সকলেরই তৃপ্তি হইল।

বরযাত্রীদের খাওয়া শেষ হইলে শম্ভুনাথবাবু আমাকে খাইতে বলিলেন। মামা বলিলেন, “সে কী কথা। বিবাহের পূর্বে বর খাইবে কেমন করিয়া।”

এ সম্বন্ধে মামার কোনো মতপ্রকাশকে তিনি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “তুমি কী বল। বসিয়া যাইতে দোষ কিছু আছে? ”

মূর্তিমতী মাতৃ-আজ্ঞা-স্বরূপে মামা উপস্থিত, তাঁর বিরুদ্ধে চলা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি আহারে বসিতে পারিলাম না।

তখন শম্ভুনাথবাবু মামাকে বলিলেন, “আপনাদিগকে অনেক কষ্ট দিয়াছি। আমরা ধনী নই, আপনাদের যোগ্য আয়োজন করিতে পারি নাই, ক্ষমা করিবেন। রাত হইয়া গেছে, আর আপনাদের কষ্ট বাড়াইতে ইচ্ছা করি না। এখন তবে—”

মামা বলিলেন, “তা,সভায় চলুন, আমরা তো প্রস্তুত আছি।”

শম্ভুনাথ বলিলেন, “তবে আপনাদের গাড়ি বলিয়া দিই? ” 🔒ব্যাখ্যা

মামা আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, “ঠাট্টা করিতেছেন নাকি? ” 🔒ব্যাখ্যা

শম্ভুনাথ কহিলেন, “ঠাট্টা তো আপনিই করিয়া সারিয়াছেন। 🔒ব্যাখ্যা ঠাট্টার সম্পর্কটাকে স্থায়ী করিবার ইচ্ছা আমার নাই।” 🔒ব্যাখ্যা

মামা দুই চোখ এতবড়ো করিয়া মেলিয়া অবাক হইয়া রহিলেন। 🔒ব্যাখ্যা

শম্ভুনাথ কহিলেন, “আমার কন্যার গহনা আমি চুরি করিব এ কথা যারা মনে করে তাদের হাতে আমি কন্যা দিতে পারি না।” 🔒ব্যাখ্যা

আমাকে একটি কথা বলাও তিনি আবশ্যক বোধ করিলেন না। 🔒ব্যাখ্যা কারণ, প্রমাণ হইয়া গেছে, আমি কেহই নই। 🔒ব্যাখ্যা

তারপরে যা হইল সে আমি বলিতে ইচ্ছা করি না। ঝাড়লণ্ঠন ভাঙিয়া-চুরিয়া, জিনিসপত্র লণ্ডভণ্ড করিয়া, বরযাত্রের দল দক্ষযজ্ঞের পালা সারিয়া বাহির হইয়া গেল। 🔒ব্যাখ্যা

বাড়ি ফিরিবার সময় ব্যান্ড রসনচৌকি ও কন্সর্ট একসঙ্গে বাজিল না এবং অভ্রেঝাড়গুলো আকাশের তারার উপর আপনাদের কর্তব্যের বরাত দিয়া কোথায় যে মহানির্বাণ লাভ করিল সন্ধান পাওয়া গেল না।

বাড়ির সকলে তো রাগিয়া আগুন। 🔒ব্যাখ্যা কন্যার পিতার এত গুমর! কলি যে চারপোয়া হইয়া আসিল! সকলে বলিল, “দেখি, মেয়ের বিয়ে দেন কেমন করিয়া।” কিন্তু মেয়ের বিয়ে হইবে না এ ভয় যার মনে নেই তার শাস্তির উপায় কী। 🔒ব্যাখ্যা

মস্ত বাংলাদেশের মধ্যে আমিই একমাত্র পুরুষ যাহাকে কন্যার বাপ বিবাহের আসর হইতে নিজে ফিরাইয়া দিয়াছে। 🔒ব্যাখ্যা এতবড়ো সৎপাত্রের কপালে এতবড়ো কলঙ্কের দাগ 🔒ব্যাখ্যা কোন নষ্ট গ্রহ এত আলো জ্বালাইয়া, বাজনা বাজাইয়া, সমারোহ করিয়া আঁকিয়া দিল? বরযাত্রীরা এই বলিয়া কপাল চাপড়াইতে লাগিল 🔒ব্যাখ্যা যে, ”বিবাহ হইল না অথচ আমাদের ফাঁকি দিয়া খাওয়াইয়া দিল— পাকযন্ত্রটাকে সমস্ত অন্নসুদ্ধ সেখানে টান মারিয়া ফেলিয়া দিয়া আসিতে পারিলে তবে আফসোস মিটিত।”

বিবাহের চুক্তিভঙ্গ ও মানহানির দাবিতে নালিশ করিব বলিয়া মামা অত্যন্ত গোল করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। হিতৈষীরা বুঝাইয়া দিল, তাহা হইলে তামাশার যেটুকু বাকি আছে তাহা পুরা হইবে।

বলা বাহুল্য, আমিও খুব রাগিয়াছিলাম। কোনো গতিকে শম্ভুনাথ বিষম জব্দ হইয়া আমাদের পায়ে ধরিয়া আসিয়া পড়েন, গোঁফের রেখায় তা দিতে দিতে এইটেই কেবল কামনা করিতে লাগিলাম ।

কিন্তু, এই আক্রোশের কালো রঙের স্রোতের পাশাপাশি আর একটা স্রোত বহিতেছিল যেটার রঙ একেবারেই কালো নয়। সমস্ত মন যে সেই অপরিচিতার পানে ছুটিয়া গিয়াছিল— এখনো যে তাহাকে কিছুতেই টানিয়া ফিরাইতে পারি না। দেয়ালটুকুর আড়ালে রহিয়া গেল গো। 🔒ব্যাখ্যা কপালে তার চন্দন আঁকা, গায়ে তার লাল শাড়ি, মুখে তার লজ্জার রক্তিমা, হৃদয়ের ভিতরে কী যে তা কেমন করিয়া বলিব। আমার কল্পলোকের কল্পলতাটি বসন্তের সমস্ত ফুলের ভার আমাকে নিবেদন করিয়া দিবার জন্য নত হইয়া পড়িয়াছিল। হাওয়া আসে, গন্ধ পাই, পাতার শব্দ শুনি— কেবল আর একটিমাত্র পা-ফেলার অপেক্ষা— এমন সময়ে সেই এক পদক্ষেপের দূরত্বটুকু এক মুহূর্তে অসীম হইয়া উঠিল ! 🔒ব্যাখ্যা

এতদিন যে প্রতি সন্ধ্যায় আমি বিনুদাদার বাড়িতে গিয়া তাঁহাকে অস্থির করিয়া তুলিয়াছিলাম। 🔒ব্যাখ্যা বিনুদার বর্ণনার ভাষা অত্যন্ত সংকীর্ণ বলিয়াই তাঁর প্রত্যেক কথাটি স্ফূলিঙ্গের মতো আমার মনের মাঝখানে আগুন জ্বালিয়া দিয়াছিল। বুঝিয়াছিলাম মেয়েটির রূপ বড়ো আশ্চর্য; কিন্তু না দেখিলাম তাহাকে চোখে, না দেখিলাম তাহার ছবি, সমস্তই অস্পষ্ট হইয়া রহিল। বাহিরে তো সে ধরা দিলই না, তাহাকে মনেও আনিতে পারিলাম না— এইজন্য মন সেদিনকার সেই বিবাহসভার দেয়ালটার বাহিরে ভূতের মতো দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বেড়াইতে লাগিল।
হরিশের কাছে শুনিয়াছি, মেয়েটিকে আমার ফোটোগ্রাফ দেখানো হইয়াছিল। পছন্দ করিয়াছে বৈকি। না করিবার তো কোনো কারণ নাই। আমার মন বলে, সে ছবি তার কোনো একটি বাক্সের মধ্যে লুকানো আছে। একলা ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া এক-একদিন নিরালা দুপুরবেলায় সে কি সেটি খুলিয়া দেখে না? যখন ঝুঁকিয়া পড়িয়া দেখে তখন ছবিটির উপরে কি তার মুখের দুই ধার দিয়া এলোচুল আসিয়া পড়ে না। হঠাৎ বাহিরে কারো পায়ের শব্দ পাইলে সে কি তাড়াতাড়ি তার সুগন্ধ আঁচলের মধ্যে ছবিটিকে লুকাইয়া ফেলে না?

দিন যায়। একটা বৎসর গেল। মামা তো লজ্জায় বিবাহসম্বন্ধের কথা তুলিতেই পারেন না। মার ইচ্ছা ছিল, আমার অপমানের কথা যখন সমাজের লোক ভুলিয়া যাইবে তখন বিবাহের চেষ্টা দেখিবেন।

এদিকে আমি শুনিলাম সে মেয়ের নাকি ভালো পাত্র জুটিয়াছিল, কিন্তু সে পণ করিয়াছে বিবাহ করিবে না। শুনিয়া আমার মন পুলকের আবেশে ভরিয়া গেল। আমি কল্পনায় দেখিতে লাগিলাম, সে ভালো করিয়া খায় না; সন্ধ্যা হইয়া আসে, সে চুল বাঁধিতে ভুলিয়া যায়। তার বাপ তার মুখের পানে চান আর ভাবেন, ”আমার মেয়ে দিনে দিনে এমন হইয়া যাইতেছে কেন। ”হঠাৎ কোনোদিন তার ঘরে আসিয়া দেখেন, মেয়ের দুই চক্ষু জলে ভরা। জিজ্ঞাসা করেন, ”মা, তোর কী হইয়াছে বল আমাকে।” মেয়ে তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছিয়া বলে, ”কই কিছুই তো হয়নি বাবা।” বাপের এক মেয়ে যে— বড়ো আদরের মেয়ে। যখন অনাবৃষ্টির দিনের ফুলের কুঁড়িটির মতো মেয়ে একেবারে বিমর্ষ হইয়া পড়িয়াছে তখন বাপের প্রাণে আর সহিল না। তখন অভিমান ভাসাইয়া দিয়া তিনি ছুটিয়া আসিলেন আমাদের দ্বারে। তার পরে? তার পরে মনের মধ্যে সেই যে কালো রঙের ধারাটা বহিতেছে সে যেন কালো সাপের মতো রূপ ধরিয়া ফোঁস করিয়া উঠিল। 🔒ব্যাখ্যা সে বলিল, ”বেশ তো আর একবার বিবাহের আসর সাজানো হোক, আলো জ্বলুক, দেশ-বিদেশের লোকের নিমন্ত্রণ হোক, তার পরে তুমি বরের টোপর পায়ে দলিয়া দলবল লইয়া সভা ছাড়িয়া চলিয়া এসো।” কিন্তু, যে ধারাটি চোখের জলের মতো শুভ্র সে রাজহংসের রূপ ধরিয়া বলিল, ”যেমন করিয়া আমি একদিন দময়ন্তীর পুষ্পবনে গিয়াছিলাম তেমনি করিয়া আমাকে একবার উড়িয়া যাইতে দাও— আমি বিরহিণীর কানে কানে একবার সুখের খবরটা দিয়া আসি গে।” তার পরে? তার পরে দুঃখের রাত পোহাইল, নববর্ষার জল পড়িল, ম্লান ফুলটি মুখ তুলিল— এবারে সেই দেয়ালটার বাহিরে রহিল সমস্ত পৃথিবীর আর সবাই আর ভিতরে প্রবেশ করিল একটিমাত্র মানুষ। তার পরে? তার পরে আমার কথাটি ফুরালো।

কিন্তু, কথা এমন করিয়া ফুরাইল না। যেখানে আসিয়া তাহা অফুরান হইয়াছে সেখানকার বিবরণ একটুখানি বলিয়া আমার এ লেখা শেষ করিয়া দিই।

মাকে লইয়া তীর্থে চলিয়াছিলাম। আমার উপরেই ভার ছিল। কারণ মামা এবারেও হাবড়ার পুল পার হন নাই। রেলগাড়িতে ঘুমাইতেছিলাম। ঝাঁকানি খাইতে খাইতে মাথার মধ্যে নানাপ্রকার এলোমেলো স্বপ্নের ঝুমঝুমি বাজিতেছিল। হঠাৎ একটা কোন স্টেশনে জাগিয়া উঠিলাম। আলোতে অন্ধকারে মেশা সেও এক স্বপ্ন। কেবল আকাশের তারাগুলি চিরপরিচিত— আর সবই অজানা অস্পষ্ট; স্টেশনের দীপ-কয়টা খাড়া হইয়া দাঁড়াইয়া আলো ধরিয়া এই পৃথিবীটা যে কত অচেনা এবং যাহা চারিদিকে তাহা যে কতই বহু দূরে তাহাই দেখাইয়া দিতেছে। গাড়ির মধ্যে মা ঘুমাইতেছেন; আলোর নীচে সবুজ পর্দা টানা; তোরঙ্গ বাক্স জিনিসপত্র সমস্তই কে কার ঘাড়ে এলোমেলো হইয়া রহিয়াছে, তাহারা যেন স্বপ্নলোকের উলট-পালট আসবাব, সবুজ প্রদোষের মিটমিটে আলোতে থাকা এবং না-থাকার মাঝখানে কেমন একরকম হইয়া পড়িয়া আছি।

এমন সময়ে সেই অদ্ভুত পৃথিবীর অদ্ভুত রাত্রে কে বলিয়া উঠিল, “শিগগির চলে আয় এই গাড়িতে জায়গা আছে।” মনে হইল, যেন গান শুনিলাম। বাঙালি মেয়ের গলায় বাংলা কথা যে কী মধুর তাহা এমনি করিয়া অসময়ে অজায়গায় আচমকা শুনিলে তবে সম্পূর্ণ বুঝিতে পারা যায়। কিন্তু, এই গলাটিকে কেবলমাত্র মেয়ের গলা বলিয়া একটি শ্রেণিভুক্ত করিয়া দেওয়া চলে না, এ কেবল একটি-মানুষের গলা; শুনিলেই মন বলিয়া ওঠে, ”এমন তো আর শুনি নাই।”

চিরকাল গলার স্বর আমার কাছে বড়ো সত্য। রূপ জিনিসটি বড়ো কম নয়, কিন্তু মানুষের মধ্যে যাহা অন্তরতম এবং অনির্বচনীয়, আমার মনে হয় কণ্ঠস্বর যেন তারই চেহারা। 🔒ব্যাখ্যা আমি তাড়াতাড়ি গাড়ির জানালা খুলিয়া বাহিরে মুখ বাড়াইয়া দিলাম, কিছুই দেখিলাম না। প্ল্যাটফর্মের অন্ধকারে দাঁড়াইয়া গার্ড তাহার একচক্ষু লণ্ঠন নাড়িয়া দিল, গাড়ি চলিল; আমি জানলার কাছে বসিয়া রহিলাম। আমার চোখের সামনে কোনো মূর্তি ছিল না, কিন্তু হৃদয়ের মধ্যে আমি একটি হৃদয়ের রূপ দেখিতে লাগিলাম। সে যেন এই তারাময়ী রাত্রির মতো, আবৃত করিয়া ধরে কিন্তু তাহাকে ধরিতে পারা যায় না। 🔒ব্যাখ্যা ওগো সুর, অচেনা কণ্ঠের সুর, এক নিমেষে তুমি যে আমার চিরপরিচয়ের আসনটির উপরে আসিয়া বসিয়াছ। 🔒ব্যাখ্যা কী আশ্চর্য পরিপূর্ণ তুমি— চঞ্চল কালের ক্ষুব্ধ হৃদয়ের উপরে ফুলটির মতো ফুটিয়াছ, অথচ তার ঢেউ লাগিয়া একটি পাপড়িও টলে নাই, অপরিমেয় কোমলতায় এতটুকু দাগ পড়ে নাই।

গাড়ি লোহার মৃদঙ্গে তাল দিতে দিতে চলিল; আমি মনের মধ্যে গান শুনিতে শুনিতে চলিলাম। তাহার একটিমাত্র ধুয়া— ‘গাড়িতে জায়গা আছে।’ আছে কি, জায়গা আছে কি। জায়গা যে পাওয়া যায় না, কেউ যে কাকেও চেনে না। অথচ সেই না-চেনাটুকু যে কুয়াশামাত্র, সে যে মায়া, সেটা ছিন্ন হইলেই যে চেনার আর অন্ত নাই। ওগো সুধাময় সুর, যে হৃদয়ের অপরূপ রূপ তুমি, সে কি আমার চিরকালের চেনা নয়। জায়গা আছে আছে— শীঘ্র আসিতে ডাকিয়াছ, শীঘ্রই আসিয়াছি, এক নিমেষও দেরি করি নাই।

রাত্রে ভালো করিয়া ঘুম হইল না। 🔒ব্যাখ্যা প্রায় প্রতি স্টেশনে একবার করিয়া মুখ বাড়াইয়া দেখিলাম, ভয় হইতে লাগিল যাহাকে দেখা হইল না সে পাছে রাত্রে নামিয়া যায়।

পরদিন সকালে একটা বড়ো স্টেশনে গাড়ি বদল করিতে হইবে। আমাদের ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট— মনে আশা ছিল, ভিড় হইবে না। নামিয়া দেখি, প্ল্যাটফর্মে সাহেবদের আর্দালি-দল আসবাবপত্র লইয়া গাড়ির জন্য অপেক্ষা করিতেছে। কোন এক ফৌজের বড়ো জেনারেল-সাহেব ভ্রমণে বাহির হইয়াছেন। দুই-তিন মিনিট পরেই গাড়ি আসিল। বুঝিলাম, ফার্স্ট ক্লাসের আশা ত্যাগ করিতে হইবে। মাকে লইয়া কোন গাড়িতে উঠি সে এক বিষম ভাবনায় পড়িলাম। সব গাড়িতেই ভিড়। দ্বারে দ্বারে উঁকি মারিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। এমন সময় সেকেণ্ড ক্লাসের গাড়ি হইতে একটি মেয়ে আমার মাকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “আপনারা আমাদের গাড়িতে আসুন না— এখানে জায়গা আছে।” 🔒ব্যাখ্যা

আমি তো চমকিয়া উঠিলাম। 🔒ব্যাখ্যা সেই আশ্চর্যমধুর কণ্ঠ এবং সেই গানেরই ধুয়া— “জায়গা আছে”। 🔒ব্যাখ্যা ক্ষণমাত্র বিলম্ব না করিয়া মাকে লইয়া গাড়িতে উঠিয়া পড়িলাম। জিনিসপত্র তুলিবার প্রায় সময় ছিল না। আমার মতো অক্ষম দুনিয়ায় নাই। 🔒ব্যাখ্যা সেই মেয়েটিই কুলিদের হাত হইতে তাড়াতাড়ি চলতি গাড়িতে আমাদের বিছানাপত্র টানিয়া লইল। আমার একটা ফটোগ্রাফ তুলিবার ক্যামেরা স্টেশনেই পড়িয়া রহিল— গ্রাহ্যই করিলাম না।

তার পরে— কী লিখিব জানি না। আমার মনের মধ্যে একটি অখণ্ড আনন্দের ছবি আছে— তাহাকে কোথায় শুরু করিব, কোথায় শেষ করিব? বসিয়া বসিয়া বাক্যের পর বাক্য যোজনা করিতে ইচ্ছা করে না।

এবার সেই সুরটিকে চোখে দেখিলাম ; তখনো তাহাকে সুর বলিয়াই মনে হইল। মায়ের মুখের দিকে চাহিলাম; দেখিলাম তাঁর চোখে পলক পড়িতেছে না। মেয়েটির বয়স ষোলো কি সতেরো হইবে, কিন্তু নবযৌবন ইহার দেহে মনে কোথাও যেন একটুও ভার চাপাইয়া দেয় নাই। 🔒ব্যাখ্যা ইহার গতি সহজ, দীপ্তি নির্মল, সৌন্দর্যের শুচিতা অপূর্ব, 🔒ব্যাখ্যা ইহার কোনো জায়গায় কিছু জড়িমা নাই।
আমি দেখিতেছি, বিস্তারিত করিয়া কিছু বলা আমার পক্ষে অসম্ভব। এমন-কি, সে যে কী রঙের কাপড় কেমন করিয়া পরিয়াছিল তাহাও ঠিক করিয়া বলিতে পারিব না। এটা খুব সত্য যে, তার বেশে ভূষায় এমন কিছুই ছিল না যেটা তাহাকে ছাড়াইয়া বিশেষ করিয়া চোখে পড়িতে পারে। সে নিজের চারি দিকের সকলের চেয়ে অধিক—রজনীগন্ধার শুভ্র মঞ্জরীর মতো সরল বৃন্তটির উপরে দাঁড়াইয়া, যে গাছে ফুটিয়াছে সে গাছকে সে একেবারে অতিক্রম করিয়া উঠিয়াছে। সঙ্গে দুটি-তিনটি ছোটো ছোটো মেয়ে ছিল, তাহাদিগকে লইয়া তাহার হাসি এবং কথার আর অন্ত ছিল না। আমি হাতে একখানা বই লইয়া সেদিকে কান পাতিয়া রাখিয়াছিলাম। যেটুকু কানে আসিতেছিল সে তো সমস্তই ছেলেমানুষদের সঙ্গে ছেলেমানুষি কথা। তাহার বিশেষত্ব এই যে, তাহার মধ্যে বয়সের তফাত কিছুমাত্র ছিল না – ছোটোদের সঙ্গে সে অনায়াসে এবং আনন্দে ছোটো হইয়া গিয়াছিল। 🔒ব্যাখ্যা সঙ্গে কতকগুলি ছবিওয়ালা ছেলেদের গল্পের বই— তাহারই কোন একটা বিশেষ গল্প শোনাইবার জন্য মেয়েরা তাকে ধরিয়া পড়িল। এ গল্প নিশ্চয় তারা বিশ পঁচিশ বার শুনিয়াছে। মেয়েদের কেন যে এত আগ্রহ তাহা বুঝিলাম। সেই সুধাকণ্ঠের সোনার কাঠিতে সকল কথা যে সোনা হইয়া ওঠে। মেয়েটির সমস্ত শরীর মন যে একেবারে প্রাণে ভরা, তার সমস্ত চলায় বলায় স্পর্শে প্রাণ ঠিকরিয়া ওঠে। তাই মেয়েরা যখন তার মুখে গল্প শোনে তখন গল্প নয়, তাহাকেই শোনে; তাহাদের হৃদয়ের উপর প্রাণের ঝর্না ঝরিয়া পড়ে। 🔒ব্যাখ্যা তার সেই উদ্ভাসিত প্রাণ আমার সেদিনকার সমস্ত সূর্যকিরণকে সজীব করিয়া তুলিল; আমার মনে হইল, আমাকে যে প্রকৃতি তাহার আকাশ দিয়া বেষ্টন করিয়াছে সে ঐ তরুণীরই অক্লান্ত অম্লান প্রাণের বিশ্বব্যাপী বিস্তার।–পরের স্টেশনে পৌঁছিতেই খাবারওয়ালাকে ডাকিয়া সে খুব খানিকটা চানা-মুঠ কিনিয়া লইল, এবং মেয়েদের সঙ্গে মিলিয়া নিতান্ত ছেলেমানুষের মতো করিয়া কলহাস্য করিতে করিতে অসংকোচে খাইতে লাগিল। আমার প্রকৃতি যে জাল দিয়া বেড়া—আমি কেন বেশ সহজে হাসিমুখে মেয়েটির কাছে এই চানা একমুঠা চাহিয়া লইতে পারিলাম না। হাত বাড়াইয়া দিয়া কেন আমার লোভ স্বীকার করিলাম না।

মা ভালো-লাগা এবং মন্দ-লাগার মধ্যে দোমনা হইয়াছিলেন। গাড়িতে আমি পুরুষমানুষ, তবু ইহার কিছুমাত্র সংকোচ নাই, বিশেষত এমন লোভীর মত খাইতেছে,সেটা ঠিক তাঁর পছন্দ হইতেছিল না; অথচ ইহাকে বেহায়া বলিয়াও তাঁর ভ্রম হয় নাই। তাঁর মনে হইল, এ মেয়ের বয়স হইয়াছে কিন্তু শিক্ষা হয় নাই। মা হঠাৎ কারো সঙ্গে আলাপ করিতে পারেন না। মানুষের সঙ্গে দূরে দূরে থাকাই তাঁর অভ্যাস। এই মেয়েটির পরিচয় লইতে তাঁর খুব ইচ্ছা, কিন্তু স্বাভাবিক বাধা কাটাইয়া উঠিতে পারিতেছিলেন না।

এমন সময় গাড়ি একটা বড়ো স্টেশনে আসিয়া থামিল। সেই জেনারেল-সাহেবের একদল অনুসঙ্গী এই স্টেশন হইতে উঠিবার উদ্যোগ করিতেছে। গাড়িতে কোথাও জায়গা নাই। বার বার আমাদের গাড়ির সামনে দিয়া তারা ঘুরিয়া গেল। মা তো ভয়ে আড়ষ্ট, আমিও মনের মধ্যে শান্তি পাইতেছিলাম না।

গাড়ি ছাড়িবার অল্পকাল পূর্বে একজন দেশি রেলওয়ে কর্মচারী নাম-লেখা দুই খানা টিকিট গাড়ির দুই বেঞ্চের শিয়রের কাছে লটকাইয়া দিয়া আমাকে বলিল, “এ গাড়ির এই দুই বেঞ্চ আগে হইতেই দুই সাহেব রিজার্ভ করিয়াছেন, আপনাদিগকে অন্য গাড়িতে যাইতে হইবে।”

আমি তো তাড়াতাড়ি ব্যস্ত হইয়া দাঁড়াইয়া উঠিলাম। মেয়েটি হিন্দিতে বলিল, “না, আমরা গাড়ি ছাড়িব না।”

সে লোকটি রোখ করিয়া বলিল, “না ছাড়িয়া উপায় নাই।”

কিন্তু মেয়েটির চলিষ্ণুতার কোনো লক্ষণ না দেখিয়া সে নামিয়া গিয়া ইংরেজ স্টেশন-মাস্টারকে ডাকিয়া আনিল। সে আসিয়া আমাকে বলিল, “আমি দুঃখিত, কিন্তু— ”

শুনিয়া আমি ‘কুলি কুলি’ করিয়া ডাক ছাড়িতে লাগিলাম। মেয়েটি উঠিয়া দুই চক্ষে অগ্নিবর্ষণ করিয়া বলিল, “না, আপনি যাইতে পারিবেন না, যেমন আছেন বসিয়া থাকুন।”
বলিয়া সে দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া স্টেশন-মাস্টারকে ইংরেজি ভাষায় বলিল, “এ গাড়ি আগে হইতে রিজার্ভ করা, এ কথা মিথ্যাকথা।”

বলিয়া নাম লেখা টিকিটটি খুলিয়া প্ল্যাটফর্মে ছুড়িয়া ফেলিয়া দিল।

ইতিমধ্যে আর্দালি-সমেত ইউনিফর্ম-পরা সাহেব দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। গাড়িতে সে তার আসবাব উঠাইবার জন্য আর্দালিকে প্রথমে ইশারা করিয়াছিল। তাহার পরে মেয়েটির মুখে তাকাইয়া, তার কথা শুনিয়া, ভাব দেখিয়া, স্টেশন-মাস্টারকে একটু স্পর্শ করিল এবং তাহাকে আড়ালে লইয়া গিয়া কী কথা হইল জানি না। দেখা গেল, গাড়ি ছাড়িবার সময় অতীত হইলেও আর-একটা গাড়ি জুড়িয়া তবে ট্রেন ছাড়িল। মেয়েটি তার দলবল লইয়া আবার একপত্তন চানা-মুঠ খাইতে শুরু করিল, আর আমি লজ্জায় জানলার বাহিরে মুখ বাড়াইয়া প্রকৃতির শোভা দেখিতে লাগিলাম । 🔒ব্যাখ্যা

কানপুরে গাড়ি আসিয়া থামিল। মেয়েটি জিনিসপত্র বাঁধিয়া প্রস্তুত— স্টেশনে একটি হিন্দুস্থানি চাকর ছুটিয়া আসিয়া ইহাদিগকে নামাইবার উদ্যোগ করিতে লাগিল।

মা তখন আর থাকিতে পারিলেন না। জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার নাম কী মা।”

মেয়েটি বলিল, “আমার নাম কল্যাণী।”

শুনিয়া মা এবং আমি দুজনেই চমকিয়া উঠিলাম।

“তোমার বাবা— ”

“তিনি এখানকার ডাক্তার, তাঁহার নাম শম্ভুনাথ সেন।”

তার পরেই সবাই নামিয়া গেল।

মামার নিষেধ অমান্য করিয়া, মাতৃ-আজ্ঞা ঠেলিয়া, তার পরে আমি কানপুরে আসিয়াছি। 🔒ব্যাখ্যা কল্যাণীর বাপ এবং কল্যাণীর সঙ্গে দেখা হইয়াছে। হাত জোড় করিয়াছি, মাথা হেঁট করিয়াছি; শম্ভুনাথবাবুর হৃদয় গলিয়াছে। 🔒ব্যাখ্যা কল্যাণী বলে, “আমি বিবাহ করিব না।”  🔒ব্যাখ্যা

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কেন।”

সে বলিল, “মাতৃ-আজ্ঞা।” 🔒ব্যাখ্যা

কী সর্বনাশ। এ পক্ষেও মাতুল আছে নাকি।  
 
তার পরে বুঝিলাম, মাতৃভূমি আছে। 🔒ব্যাখ্যা সেই বিবাহ-ভাঙার পর হইতে কল্যাণী মেয়েদের শিক্ষার ব্রত গ্রহণ করিয়াছে।  🔒ব্যাখ্যা

কিন্তু আমি আশা ছাড়িতে পারিলাম না। সেই সুরটি যে আমার হৃদয়ের মধ্যে আজও বাজিতেছে— সে যেন কোন ওপারের বাঁশি— আমার সংসারের বাহির হইতে আসিল— সমস্ত সংসারের বাহিরে ডাক দিল। আর, সেই-যে রাত্রির অন্ধকারের মধ্যে আমার কানে আসিয়াছিল ”জায়গা আছে”, সে যে আমার চিরজীবনের গানের ধুয়া হইয়া রহিল। তখন আমার বয়স ছিল তেইশ, এখন হইয়াছে সাতাশ। এখনো আশা ছাড়ি নাই, কিন্তু মাতুলকে ছাড়িয়াছি। 🔒ব্যাখ্যা নিতান্ত এক ছেলে বলিয়া মা আমাকে ছাড়িতে পারেন নাই। 🔒ব্যাখ্যা

তোমরা মনে করিতেছ, আমি বিবাহের আশা করি? না, কোনো কালেই না। আমার মনে আছে, কেবল সেই একরাত্রির অজানা কণ্ঠের মধুর সুরের আশা— জায়গা আছে। নিশ্চয়ই আছে। নইলে দাঁড়াব কোথায়। তাই বৎসরের পর বৎসর যায়— আমি এইখানেই আছি। দেখা হয়, সেই কণ্ঠ শুনি, যখন সুবিধা পাই কিছু তার কাজ করে দিই— আর মন বলে, এই তো জায়গা পাইয়াছি। ওগো অপরিচিতা, তোমার পরিচয়ের শেষ হইল না, শেষ হইবে না; 🔒ব্যাখ্যা কিন্তু ভাগ্য আমার ভালো, এই তো আমি জায়গা পাইয়াছি।  


সারসংক্ষেপ:

সমগ্র বাংলা সাহিত্যের ছোট গল্পের সার্থক স্রষ্টা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি অসখ্য ছোট গল্প রচনা করেছেন। ‘অপরিচিতা’ গল্পটি সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছোট গল্প। এগল্পটি আবর্তিত হয়েছে ঘৃণ্য যৌতুক প্রথাকে কেন্দ্র করে। ‘অপরিচিতা’ গল্পে অপরিচিতা বিশেষণের আড়ালে বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী যে নারীর কাহিনি বর্ণিত হয়েছে, তার নাম কল্যাণী। রবীন্দ্রনাথ পৈশাচিক যৌতুক প্রথার নির্মম বলি হয়েছে এমন নারীদের গল্প ইতঃপূর্বে রচনা করেছিলেন। কিন্তু এই গল্পে প্রথমেই তিনি যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রতিরোধের কথকতা শোনালেন। এ গল্পে পিতা শম্ভুনাথ সেন এবং কন্যা কল্যাণীর স্বতন্ত্র বীক্ষা ও আচরণে সমাজে গেড়ে-বসা ঘৃণ্য যৌতুকপ্রথা প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। পিতার বলিষ্ঠ প্রতিরোধ এবং কন্যা কাল্যাণীর দেশচেতনায় ঋদ্ধ ব্যক্তিত্বের জাগরণ ও তার অভিব্যক্তিতে গল্পটি যথার্থই সার্থক হয়েছে। ‘অপরিচিতা’ গল্পের নায়ক অনুপম বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের যুদ্ধসংলগ্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর উপাধি অর্জন করেও ব্যক্তিত্বরহিত বাঙালি যুবক রয়ে গেছে। সে পরিবারতন্ত্রের কাছে অসহায় পুতুলমাত্র। সে মায়ের অনুগত সন্তান। সে নিজেকে একজন ভালো মানুষ তথা সৎপাত্র হিসেবে নিজেকে দাবি করে। তারই বিয়ে উপলক্ষে যৌতুক নিয়ে নরীর চরম অবমাননাকালে শম্ভুনাথ সেনের কন্যা-সম্প্রদানে অসম্মতি গল্পটির শীর্ষ মুহূর্ত। অনুপম নিজের গল্প বলতে গিয়ে ব্যাঙ্গার্থে সেই অঘটন সংঘটনের কথাটি জানিয়ে দিয়েছে। বিয়ের লগ্ন যখন প্রস্তুত তখন কন্যার লগ্নভ্রষ্ট হওয়ার লৌকিকতাকে অগ্রাহ্য করে কন্যার পিতা শম্ভুনাথ সেনের নির্বিকার অথচ বলিষ্ঠ প্রত্যাখান নতুন এক সময়ের আশু আবির্ভাবকেই সংকেতবহ করে তুলেছে। কর্মীর ভূমিকায় বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের জাগরণের মধ্যদিয়ে গল্পের শেষাংশে কল্যাণীর শুচিশুভ্র আত্মপ্রকাশও ভবিষ্যতের নতুন নারীর আগমনীর ইঙ্গিতে পরিসমাপ্ত। ‘অপরিচিতা’ মনস্তাপে ভেঙেপড়া এক ব্যক্তিত্বহীন যুবকের স্বীকারোক্তিমূলক গল্প। তার পদস্খলনের অকপট কথামালা। অনুপমের আত্মবিবৃতির সূত্র ধরেই গল্পের নারী কল্যাণী অসামান্যা হয়ে উঠেছে। গল্পটিতে পুরুষতন্ত্রের অমানবিকতার স্ফুরণ যেমন ঘটেছে, তেমনি একই সঙ্গে পুরুষের ভাষ্যে নারীর প্রশস্তিও কীর্তিত হয়েছে।

উত্তর : অনুপমের বন্ধু হরিশ কানপুরে কাজ করে।

উত্তর : কল্যাণীর বিয়ের গহনাগুলি পিতামহীদের আমলের।

উত্তর : অনুপমকে ‘মাকাল ফলে’ এর সাথে তুলনা করে বিদ্রুপ করেছিল পণ্ডিতমশায়।

উত্তর : রবীন্দ্রনাথের সর্বশেষ গল্পের নাম ‘মুসলমানীর গল্প’।

উত্তর : "রসনচৌকি" শব্দের অর্থ শানাই, ঢোল ও কাঁসি এই তিনটি বাদ্যযন্ত্রের সৃষ্ট ঐকতানবাদন।

উত্তর : ‘অপরিচিতা’ গল্পের মামা অনুপমের চেয়ে ছয় বছরের বড়।

উত্তর : অনুপমের বাবার পেশা ছিল ওকলাতি বা আইন ব্যবসায়।

উত্তর : গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে বিস্তর লোকের আদর-আপ্যায়ন করে তাদের বিদায় দিতে কনেপক্ষকে যে নাকাল হতে হবে সে কথা স্মরণ করে অনুপমের মামা ও মা ‘একযোগে বিস্তর হাসিলেন।’

উত্তর : পণ্ডিত মশায় অনুপমকে ‘মাকাল ফলে’র সঙ্গে তুলনা করে বিদ্রুপ করেছিলেন।

উত্তর : ‘অপরিচিতা’ গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩২১ বঙ্গাব্দে(১৯১৪) প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার কার্তিক সংখ্যায়।

উত্তর : প্রশ্নোক্ত উক্তিটি শম্ভুনাথসেনের আত্মসম্নানবোধের বিষয়টি ফুটে উঠেছে। অনুপমের মামা বিয়ের পূর্বমহূর্তে কনের পরিহিত সকল গয়না পরখ করে দেখতে চান। তার এ সংগত প্রস্তাব দৃঢ়চিত্ত শম্ভুনাথ সেনের  আত্মমর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে। এজন্য তিনি কৌশলে বরযাত্রীদের খাওয়ার কথা বলেন। আর এতে অনুপমের মামা বিস্মিত হয়ে লগ্নের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে শম্ভুনাথ সেন উপর্যুক্ত মন্তব্যটি করেন।

উত্তর : কল্যাণীর কিশোরীসুলভ মানসিকতার প্রসঙ্গে প্রশ্নোক্ত উক্তিটি করা হয়েছে। 

‘অপরিচিতা’ গল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্র অনুপম। গল্পের নায়িকা কল্যাণীর সাথে তার বিয়ে হওয়ার কথা থাকলেও তার মামার যৌতুকলোভী আচরণের কারণে বিয়ে ভেঙে যায়। উল্লেখ্য যে কল্যাণীর সাথে তার বিয়ে হওয়ার কথা থাকলেও কল্যাণীকে সে সরাসরি কখনো দেখেনি। কল্যাণীর সাথে তার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর  সে কোনো এক সময় তার মাকে নিয়ে তীর্থে যাত্রা করে।  যাত্রাপথে কল্যাণীর  সাথে তাদের ট্রেনে দেখা হয়। কল্যাণীর সাথে তখন দুই-তিনটা ছোট ছোট মেয়ে ছিল। এই মেয়েদের নিয়ে কল্যাণীর কথা ও হাসির  অন্ত ছিল না। ছোটদের সঙ্গে সে অনায়াসে ও অনন্দে ছোট হয়ে গিয়েছিল। অর্থ্যৎ কল্যাণীর শিশুসুলভ মানসিকতার করণে প্রশ্নোক্ত বাক্যে অনুপমের মনোভাব প্রকাশ করা হয়েছে।

উত্তর : প্রশ্নোক্ত উক্তির মাধ্যমে ‘অপরিচিতা’ গল্পের কথক অনুপম গল্পের প্রধান চরিত্র কল্যাণীর বয়স বৃদ্ধি এবং তাকে বিয়ে না দেওয়ার কারণ নির্দেশ করেছেন।

কল্যাণীর বয়স পনেরো। তৎকালীন সমাজব্যবস্থা অনুযায়ী পাত্রীর এ বয়স একটু বেশি বলে-ই ধরা হয়। অন্যদিকে, উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান মেলাও ছিল তখন কষ্টকর কাজ। তার উপরে কল্যাণীর পিতা দৃড়ভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে, উপযুক্ত পাত্র ছাড়া তিনি কন্যাকে পাত্রস্থ করবেন না।  এই দুই পরিস্থিতির কারণেই কল্যাণীর বয়স দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু তার জন্য উপযুক্ত পাত্রের সন্ধ্যান মিলছে না। এমন জটিল পরিস্থিতির বর্ণনা করতে গিয়েই গল্পকথক বলেন, ‘একে তো বরের হাট মহার্ঘ, তাহার পরে ধনুক ভাঙা পণ’...। অর্থাৎ এখানে গল্পকথক কল্যাণীর বয়স বৃদ্ধি এবং তাকে বিয়ে না দেওয়ার কারণ নির্দেশ করেছেন।

উত্তর : প্রশ্নোক্ত উক্তির মাধ্যমে ‘অপরিচিতা’ গল্পের কথক অনুপম গল্পের প্রধান চরিত্র কল্যাণীর বয়স বৃদ্ধি এবং তাকে বিয়ে না দেওয়ার কারণ নির্দেশ করেছেন।

কল্যাণীর বয়স পনেরো। তৎকালীন সমাজব্যবস্থা অনুযায়ী পাত্রীর এ বয়স একটু বেশি বলে-ই ধরা হয়। অন্যদিকে, উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান মেলাও ছিল তখন কষ্টকর কাজ। তার উপরে কল্যাণীর পিতা দৃড়ভাবে  প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে, উপযুক্ত পাত্র ছাড়া তিনি কন্যাকে পাত্রস্থ করবেন না।  এই দুই পরিস্থিতির কারণেই কল্যাণীর বয়স দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু তার জন্য উপযুক্ত পাত্রের সন্ধ্যান মিলছে না। এমন জটিল পরিস্থিতির বর্ণনা করতে গিয়েই গল্পকথক বলেন, ‘একে তো বরের হাট মহার্ঘ, তাহার পরে ধনুক ভাঙা পণ’...। অর্থাৎ এখানে গল্পকথক কল্যাণীর বয়স বৃদ্ধি এবং তাকে বিয়ে না দেওয়ার কারণ নির্দেশ করেছেন।

উত্তর : বিয়েবাড়িতে বরযাত্রীদের জায়গা সংকুলান না হওয়া এবং বিয়ের সমস্ত আয়োজন ও আতিথেয়তা প্রত্যাশিত না হওয়ায় মামা বিয়েবাড়িতে ঢুকে খুশি হলেন না।

অনুপম-কল্যাণীর বিয়ের অনুষ্ঠানে অনুপমের মামা বরযাত্রীসহ উপস্থিত হয়ে দেখতে গেলেন বিয়েবাড়িতে বরযাত্রীদের জায়গা সংকুলান হচ্ছে না। কন্যার পিতা হিসেবে শম্ভুনাথ সেনের ব্যবহারটাও মামার কাছে নেহায়েত ঠান্ডা অনুভূত হয়। এমনকি তাঁর বিনয়টাও যথাযথ ছিল না। তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ, বাহ্যিক সোন্দর্যও মামার ভালো লাগেনি। তৎকালীন সমাজের সম্ভ্রান্ত্র পরিবার হিসেবে বিয়েবাড়িতে কন্যাপক্ষের কাছে যতটা জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশের মধ্য দিয়ে আদর-আপ্যায়ন প্রত্যাশা করেছিলেন সেই তুলনায় তা স্বল্প হওয়ায় মামা বিয়েবাড়িতে ঢুকে খুশি হলেন না।

উত্তর : অনুপম তার জীবনের করুণ বাস্তবতার স্মৃতিকে রোমন্থনপূর্বক আলোচ্য উক্তিটি করে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত অনুপম ‘অপরিচিতা’ গল্পের কথক এবং নায়ক। সে ছেলেবেলা হতে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে প্রফুল্লচিত্তে অন্যান্য চঞ্চল ছেলেদের মতোই বেড়ে উঠেছে। কিন্তু আজ তার বয়স সাতাশ। এই সাতাশ বছর বয়সে একদিনের সেই চনমনা ছেলের জীবনে ঘটেছে নারী ঘটিত এক করুণ ইতিহাস। কল্যাণীকে বিয়ে করতে গিয়ে তার মামার যে অর্থলোলুপতা ও দুরাচারিতা সেটিই অনুপমকে বিয়ে বাড়ি হতে অসম্মানের সাথে বিতাড়িত করেছে। সেদিনকার প্রতিটি মুহূর্ত আজ অনুপমের মনে দুঃখের সাথে স্মরণ হচ্ছে। যদিও আজ তার বয়স কুড়ি পেরিয়ে সাতাশ হয়েছে।

উত্তর :
আলোচ্য বাক্যে বোঝানো হয়েছে, আকারে বা ব্যপ্তিতে ছোটকে যারা ক্ষুদ্র বা তুচ্ছ জ্ঞান করেন না, তারাই বৃহৎ ব্যক্তি, বস্তু, ঘটনা বা কাহিনির মমার্থ অনুধাবন করতে পারেন।
ছোট মাত্রই ক্ষুদ্র নয়, সামান্য মাত্রই তুচ্ছ নয়। অনুপমের তেইশ থেকে সাতাশ বছর বয়সের পরিধি ক্ষুদ্র, ইতিহাসটুকু ছোট। সেই সময়ে তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা ব্যাপক ও তাৎপর্যপূর্ণ, যেন জল বিন্দুর মাঝে সিন্ধুর গভীরতা। এর রসমাধুর্যটুকু চয়ন করে নিতে হয়। তাই কোনো ব্যক্তি, বস্তু, ঘটনা বা কাহিনির আকৃতি বা ব্যপ্তির চেয়ে তার গুরুত্বকে যারা বড় করে দেখেন তারাই অনুপমের ঐ সময়ের ঘটনার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারবেন।

উত্তর :
অপূর্ব চেহারা কিন্তু মেধার কমতির প্রতি লক্ষ করেই ছেলে বেলায় পণ্ডিত মশায় অনুপমকে শিমুল ফুল বা মাকাল ফলের সাথে তুলনা করতেন।
রক্ত রাঙা শিমুল ফুল দেখতে খুবই সুন্দর কিন্তু তাতে কোনো গন্ধ নেই। মাকাল ফলও তেমনি লোভনীয় সৌন্দর্যের অধিকারী অথচ খাদ্য হিসেবে তা একেবারেই অনুপযুক্ত। সমাজে এমন সুদর্শন অথচ গুণহীন ব্যক্তিকে বুঝাতে শিমুল ফুল বা মাকাল ফল কথা ব্যবহৃত হয়। অনুপম ছেলেবেলায় দেখতে সুদর্শন ছিলেন কিন্তু সেই অনুপাতে মেধার পরিচয় দিতে না পারায় পণ্ডিত মশায় তাকে উপযুক্ত অভিধায় অভিহিত করতেন।

উত্তর :
অনুপমকে পণ্ডিত মশায়েরা বিদ্রুপ করতেন সুন্দর চেহারা অথচ গুণহীনের কারণে।
ছোটবেলায় অনুপমের চেহারা অত্যন্ত সুন্দর ছিল। অথচ সে অনায়াশী মেধার পরিচয় দিতে পারত না। অন্যদিকে শিমুল ফুল সুবাস ছড়ায় না, সুন্দর দেখায় আর মাকাল ফল বাইরে দেখতে সুন্দর অথচ ভেতরে দুর্গন্ধ ও শাঁসযুক্ত হওয়ায় খাওয়ার যোগ্য নয়। তাই পণ্ডিত মশায়েরা তাকে শিমুল ফুল ও মাকাল ফলের সাথে তুলনা করেছেন।

উত্তর :
উদ্ধৃত উক্তিটিতে অনুপমের আইনজীবী বাবার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে বিরামহীন কর্মজীবনের অবসানের কথা বলা হয়েছে।
‘অপরিচিতা’ গল্পের বর্ণিত অনুপমের বাবা এককালে খুবই গরিব ছিলেন। ওকালতি পেশার মাধ্যমে তিনি যশ-খ্যাতি ও প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। কিন্তু তা ভোগ করার জন্য যতটুকু অবকাশ যাপন করা দরকার তা তিনি করেননি। মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তিনি জীবনে প্রথম অবসর পেয়েছেন।

ক) ১৮৩৮
খ) ১৮৪১
গ) ১৮৬১
ঘ) ১৮৯৯

উত্তর : গ
_

ক) ১৮৯১
খ) ১৮৯৪
গ) ১৯৪১
ঘ) ১৯৪৬

উত্তর : গ
_

ক) জীবনটা তুচ্ছ
খ) জীবনটা অসাধারণ
গ) স্বল্প অভিজ্ঞতা
ঘ) স্বল্প চাহিদা

উত্তর : ক
_

ক) মামা
খ) বিনুদাদা
গ) পণ্ডিত মশাই
ঘ) হরিশ

উত্তর : গ
_

ক) তীর্থযাত্রা
খ) চাকুরী থেকে অবসর
গ) মৃত্যু
ঘ) সংহিতা পাঠ

উত্তর : গ
_

Score Board

-









_

_









_

_









_

_









_

_









_
Score Board

উত্তর :

ক) উত্তর: বিয়ের তিন দিন পূর্বে শম্ভুনাথ সেন অনুপমকে দেখেছিল।

খ) উত্তর: “ঠাট্টার সম্পর্কটাকে স্থায়ী করিবার ইচ্ছা আমার নাই”- উক্তিটি 

শম্ভুনাথ সেন বরপক্ষকে বিদায় জানানোর প্রসঙ্গে করেছিলেন। বরপক্ষের যৌতুকের প্রতি অতিরিক্ত লোভ দেখে কল্যাণীর বাবা শম্ভুনাথ সেন মেয়ের বিয়ে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

কারণ যাদের মনমানসিকতা এত নীচ যে, গহনার পরিমাপ ও মান যাচাইয়ের জন্য সেকরা নিয়ে আসে তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা শম্ভুনাথ সেনের ছিল না। তাই তিনি বিয়ের আগেই জোর করে বরপক্ষকে খাওয়া-দাওয়া করানো এবং তাদের বাড়ি যাওয়ার জন্য গাড়ি ডেকে দিতে চান। বরের মামা বিষয়টিকে ঠাট্টা মনে করেন। আর এর জবাবেই শম্ভুনাথ সেন। ঠাট্টার সম্পর্কটাকে স্থায়ী করার ইচ্ছে নেই বলে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন। কল্যাণীর বাবা শম্ভুনাথ সেন লোভী এবং ব্যক্তিত্বহীনদের সাথে আত্মীয়তা করতে না চেয়ে প্রশ্নোক্ত উক্তিটি করেন।

গ) উত্তর: ব্যক্তিত্বহীনতার দিক দিয়ে উদ্দীপকের শওকত ও ‘অপরিচিতা’ 

গল্পের অনুপমের মধ্যে সাদৃশ্য বিদ্যমান। 

স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য সবার আগে প্রয়োজন সাহস ও মানসিক দৃঢ়তা। যাদের সেই সাহস ও দৃঢ়তা নেই তারা সহজেই অন্যের কাছে নিজের ইচ্ছাকে বিসর্জন দেয়। চোখের সামনে অন্যায় হলেও তারা প্রতিবাদ করতে পারে না।

উদ্দীপকে যৌতুক লোভী ব্যক্তিত্বহীন বর এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করে আত্মমর্যাদা বজায় রাখা কনের কথা বলা হয়েছে। এখানে স্কুল শিক্ষক শওকতের সম্মতিতে তার ফুফু মেয়ের বাবার কাছে যৌতুক দাবি করেছে। দাবিকৃত যৌতুক পরিশোধ না করলে পাঁচ বছরেও মেয়ে ঘরে না নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। বিয়ের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর বর পক্ষের এমন হীন মানসিকতার পরিচয় পেয়ে ফারজানা তার স্বামী শওকতকে তালাক দিয়েছে।

উদ্দীপকের শওকতের ব্যক্তিহীনতার এই দিকটি ‘অপরিচিতা’ গল্পের অনুপমের ব্যক্তিত্বহীনতার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। গল্পে শম্ভুনাথ সেন তার মেয়ের গহনা পরীক্ষার বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে অনুপম তার মামার হীনমানসিকতার পক্ষে মত দিয়েছে। সে নিজের শিক্ষা ও মনুষ্যত্বের পরিচয় দিয়ে মামার অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারেনি।

উদ্দীপকের শওকত একজন ব্যক্তিত্বহীন পুরুষ তাই সে ফুফুর সিদ্ধান্তের উপর কথা বলতে পারেনি। ‘অপরিচিতা’ গল্পের অনুপমও একই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। কারণ সেও মামার বিরুদ্ধে কথা বলেনি।

ঘ) উত্তর: ‘‘কল্যাণী আর ফারজানার মতো সাহসী মেয়েরাই পারে সমাজ 

থেকে কু-প্রথাকে দূর করে সমাজকে সুস্থ রাখতে।”- মন্তব্যটি যথার্থ।

সমাজে নারীরা নানা দিক থেকে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়। সেসবের মধ্যে যৌতুক বা পণপ্রথা অন্যতম একটি। যৌতুক বা পণপ্রথা একটি সামাজিক ব্যাধি। এই প্রথার বিরুদ্ধে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সচেতন না হলে এই প্রথা বন্ধ করা যাবে না। তাই সবার উচিত যৌতুককে ‘না’ বলা। 

উদ্দীপকে যৌতুক লোভী বরপক্ষকে যৌতুক না দিয়ে বিদায় করে দেওয়ার ঘটনা প্রতিফলিত হয়েছে। এখানে যৌতুকের দাবিদার শওকতকে তার স্ত্রী ফারজানা যৌতুক না দিয়ে নিজের আত্মমর্যাদা বজায় রেখেছে এবং একটি অন্যায়ের প্রতিবাদ করে একজন শিক্ষিত সচেতন মানুষের পরিচয় দিয়েছে। এই বিষয়টি ‘অপরিচিতা’ গল্পে বিয়ের আসরে সেকরা নিয়ে মেয়ের গহনা পরীক্ষা করতে চাইলে মামার অন্যায়ের কোনো প্রতিবাদ না করায় অনুপমের কাছে শম্ভুনাথ সেনের কন্যাকে বিয়ে না দেওয়ার ঘটনার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এখানে অনুপমের ব্যক্তিত্বহীনতার কারণে কল্যাণীও তাকে বিয়ে করতে সম্মত হয় না। ‘অপরিচিতা’ গল্পে কল্যাণীর ব্যক্তিত্ব আত্মমর্যাদাবোধ এবং যুগ যুগ ধরে গেড়ে বসা ঘৃণ্য সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ প্রকাশ পেয়েছে। 

উদ্দীপকের ফারজানার মধ্যে অনুরূপ চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে। ‘অপরিচিতা’ গল্পে শম্ভুনাথ সেন এবং কল্যাণীর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ও প্রতিবাদী আচরণ বরপক্ষের অন্যায়ের প্রতিবাদের সঙ্গে উদ্দীপকের ফারজানার শওকতকে তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত একসূত্রে গাঁথা। এই দিক থেকে প্রশ্নোক্ত মন্তব্যটি যথার্থ।

উদ্দীপকের ফারজানা লোভী ও ব্যক্তিত্বহীন স্বামীকে তালাক দিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে। অপরিচিতা’ গল্পের কল্যাণীও বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে পুরুষতান্ত্রিক ও লোভী সমাজের মর্মমূলে আঘাত করেছে।