বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কবি- পরিচিতি:
প্রকৃত নাম : মধুসূদন দত্ত ।
উপাধি : মাইকেল ।
পিতৃ প্রদত্ত নাম : শ্রী মধুসূদন দত্ত
জন্ম : ২৫শে জানুয়ারি ১৮২৪ সালে ।
জন্মস্থান : যশোর জেলার কপোতাক্ষনদ বিধৌত সাগরদাঁড়ি গ্রামে ।
পিতার নাম : রাজ নারায়ণ দত্ত । তিনি সম্ভ্রান্ত জমিদার ছিলেন ।
মাতার নাম : জাহ্নবী দেবী ।
পিতামহের নাম : রামকিশোর দত্ত ।
শিক্ষাজীবন : কলকাতার লালবাজার গ্রামার স্কুল, হিন্দু কলেজ, হিন্দু কলেজ থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর বিশপ্স কলেজে ভর্তি হন এবং পরে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলেতে গমন করেন ।
কর্মজীবন : প্রথম জীবনে আইন পেশায় জড়িত হলেও লেখালেখি করে পরবর্তীকালে জীবিকা নির্বাহ করেন ।
ভাষা জ্ঞান : গ্রিক, ল্যাটিন, হিব্র, ফরাসি, জার্মান, ইতালিয়সহ ১৩/১৪টি ভাষা ।
খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হন : ১৮৪৩ সালে, তখন থেকেই নামের আগে ‘মাইকেল’ শব্দটি যুক্ত হয় ।
মধুসূদনের ভুল : প্রথম জীবনে মাতৃভাষা ও সাহিত্যকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করা ।
চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন : বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদান রেখে ।
মৃত্যু : ২৯শে জুন ১৮৭৩ সালে, কলকাতায় ।
“এতক্ষণে”- অরিন্দম কহিলা বিষাদে- 🔒ব্যাখ্যা
”জানিনু কেমনে আসি লক্ষ্মণ পশিল
রক্ষঃপুরে! 🔒ব্যাখ্যা হায়, তাত, উচিত কি তব
এ কাজ, 🔒ব্যাখ্যা নিকষা সতী তোমার জননী,
সহোদর রক্ষঃশ্রেষ্ঠ? শূলিশম্ভুনিভ
কুম্ভকর্ণ? ভ্রাতৃপুত্র বাসববিজয়ী! 🔒ব্যাখ্যা
নিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে? 🔒ব্যাখ্যা
চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে? 🔒ব্যাখ্যা
কিন্তু নাহি গঞ্জি তোমা, গুরু জন তুমি 🔒ব্যাখ্যা
পিতৃতুল্য। ছাড় দ্বার, যাব অস্ত্রাগারে,
পাঠাইব রামানুজে শমন-ভবনে, 🔒ব্যাখ্যা
লঙ্কার কলঙ্ক আজি ভঞ্জিব আহবে।” 🔒ব্যাখ্যা
উত্তরিলা বিভীষণ, “বৃথা এ সাধনা,
ধীমান্! রাঘবদাস আমি; কী প্রকারে
তাঁহার বিপক্ষ কাজ করিব, রক্ষিতে
অনুরোধ?" 🔒ব্যাখ্যা উত্তরিলা কাতরে রাবণি;-
“হে পিতৃব্য, তব বাক্যে ইচ্ছি মরিবারে! 🔒ব্যাখ্যা
রাঘবের দাস তুমি? কেমনে ও মুখে
আনিলে এ কথা, 🔒ব্যাখ্যা তাত, কহ তা দাসেরে!
স্থাপিলা বিধুরে বিধি স্থাণুর ললাটে; 🔒ব্যাখ্যা
পড়ি কি ভূতলে শশী যান গড়াগড়ি
ধূলায়? 🔒ব্যাখ্যা হে রক্ষোরথি, ভুলিলে কেমনে
কে তুমি? জনম তব কোন মহাকুলে? 🔒ব্যাখ্যা
কে বা সে অধম রাম? স্বাচ্ছ সরোবরে
করে কেলি রাজহংস পঙ্কজ-কাননে;
যায় কি সে কভু, প্রভু, পঙ্কিল সলিলে, 🔒ব্যাখ্যা
শৈবালদলের ধাম? মৃগেন্দ্র কেশরী,
কবে, হে বীরকেশরী, সম্ভাষে শৃগালেমিত্রভাবে?🔒ব্যাখ্যা অজ্ঞ দাস, বিজ্ঞতম তুমি,
অবিদিত নহে কিছু তোমার চরণে।
ক্ষুদ্রমতি নর, শূর, লক্ষ্মণ; নহিলে
অস্ত্রহীন যোধে কি সে সম্বোধে সংগ্রামে? 🔒ব্যাখ্যা
কহ, মহারথী, এ কি?
নাহি শিশু লঙ্কাপুরে, শুনি না হাসিবে
এ কথা! 🔒ব্যাখ্যা ছাড়হ পথ; আসিব ফিরিয়া
এখনি! দেখিব আজি, কোন্ দেববলে,
বিমুখে সমরে মোরে সৌমিত্রি কুমতি! 🔒ব্যাখ্যা
দেব-দৈত্য-নর-রণে, স্বচক্ষে দেখেছ,
রক্ষঃশ্রেষ্ঠ, পরাক্রম দাসের! কী দেখি
ডরিবে এ দাস হেন দুর্বল মানবে? 🔒ব্যাখ্যা
নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে প্রগল্ভে পশিল
দম্ভী; 🔒ব্যাখ্যা আজ্ঞা কর দাসে, শাস্তি নরাধমে 🔒ব্যাখ্যা
তব জন্মপুরে, তাত, পদার্পণ করে
বনবাসী! 🔒ব্যাখ্যা হে বিধাতঃ, নন্দন-কাননে
ভ্রমে দুরাচার দৈত্য? 🔒ব্যাখ্যা প্রফুল্ল কমলে
কীটবাস? 🔒ব্যাখ্যা কহ তাত, সহিব কেমনে।
হেন অপমান আমি,- ভ্রাতৃ-পুত্র তব?
তুমিও, হে রক্ষোমণি, সহিছ কেমনে?” 🔒ব্যাখ্যা
মহামন্ত্র-বলে যথা নম্রশিরঃ ফণী,
মলিনবদন লাজে, 🔒ব্যাখ্যা উত্তরিলা রথী
রাবণ-অনুজ, লক্ষি রাবণ-আত্মজে;
“নহি দোষী আমি, বৎস; বৃথা ভর্ৎস মোরে 🔒ব্যাখ্যা
তুমি! নিজ কর্ম-দোষে, হায়, মজাইলা
এ কনক-লঙ্কা রাজা, মজিলা আপনি! 🔒ব্যাখ্যা
বিরত সতত পাপে দেবকুল; এবে
পাপপূর্ণ লঙ্কাপুরী; প্রলয়ে যেমতি
বসুধা, ডুবিছে লঙ্কা এ কালসলিলে! 🔒ব্যাখ্যা
রাঘবের পদাশ্রয়ে রক্ষার্থে আশ্রয়ী।
তেঁই আমি। পরদোষে কে চাহে মজিতে?” 🔒ব্যাখ্যা
রুষিলা বাসবত্রাস। গম্ভীরে যেমতি
নিশীথে অম্বরে মন্দ্রে জীমূতেন্দ্র কোপি, 🔒ব্যাখ্যা
কহিলা বীরেন্দ্র বলী,-“ধর্মপথগামী,
হে রাক্ষসরাজানুজ, বিখ্যাত জগতে
তুমি; — কোন্ ধর্ম মতে, কহ দাসে, শুনি,
জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জাতি,-এ সকলে দিলা
জলাঞ্জলি? 🔒ব্যাখ্যা শাস্ত্রে বলে, গুণবান্ যদি
পরজন, গুণহীন স্বজন, 🔒ব্যাখ্যা তথাপি
নির্গণ স্বজন শ্রেয়ঃ, পরঃ পরঃ সদা!
এ শিক্ষা, হে রক্ষোবর, কোথায় শিখিলে?
কিন্তু বৃথা গঞ্জি তোমা! হেন সহবাসে,
হে পিতব্য, বর্বরতা কেন না শিখিবে? 🔒ব্যাখ্যা
গতি যার নীচ সহ, নীচ সে দুর্মতি।”
i) নিজ গৃহপথ, তাত দেখাও তস্করে?
ii) রাঘব দাস আমি; কী প্রকারে/তাঁহার বিপক্ষ কাজ করিব।
iii) গতি যায় নীচ সহ, নীচ সে দুর্মতি।
ক) উত্তর: লক্ষ্মণ। সুমিত্রার গর্ভজাত সন্তান বলে লক্ষ্মণের অপর নাম সৌমিত্রি। |
খ) উত্তর “লঙ্কার কলঙ্ক আজি ভঞ্জিব আহবে”-বলতে শত্রু লক্ষ্মণ যুদ্ধে পরাস্ত করে লঙ্কার কলঙ্ক মোচনের কথা বোঝানো হয়েছে। লক্ষ্মণ ও লক্ষ্মণের আচরণকেই মেঘনাদ লঙ্কার কলঙ্ক বলতে চেয়েছেন, কারণ তস্কর বা চোরের মতো লক্ষণ গোপনে সুরক্ষিত লঙ্কাপুরীর নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে প্রবেশ করে নিরস্ত মেঘনাদকে যুদ্ধে আহ্বান করে। এটা লঙ্কার কলঙ্ক। কিন্তু মেঘনাদ যে বীর! তাই তিনি লক্ষ্মণের কাছে যুদ্ধসাজ প্রার্থনা করেন। তখন লক্ষ্মণ রাজি হয় না বরং কাপুষের মতো নিরস্ত্র মেঘনাদকে হত্যা করতে কোষ হতে তরবারি উন্মুক্ত করে। মেঘনাদ তথা লঙ্কার সে অপরাজেয় গৌরবের ঐতিহ্য আছে তাতে কালিমা লেপন করতে এসেছে লক্ষ্মণ। তাই সে রামের অনুজ লক্ষ্মনকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে চায়। তার সাথে যুদ্ধ করে, তাকে পরাজিত করে লঙ্কার সমস্ত কলঙ্ক কালিমা মুছে দিতে চায়। |
গ) উত্তর: উদ্দীপকটি ‘বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ’ কবিতায় প্রতিফলিত জন্মভূমির প্রতি মেঘনাদের গভীর অনুরাগের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। জন্মভূমি প্রত্যেক মানুষের কাছেই পরম শ্রদ্ধার বস্তু। স্বদেশের মাটি, পানি, আলো-বাতাসেই মানুষ বেড়ে ওঠে। স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য ছুটে বেড়ায় নানা দিকে। দিন শেষে পাখি যেমন ফিরে আসে তার শান্তির নীড়ে মানুষও তেমনি নানা দেশ ঘুরে স্বদেশের মাটিতেই শেষ আশ্রয় নিতে চায়। উদ্দীপকে স্বদেশের প্রতি মানুষের অনুরাগ ও ভালোবাসার পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। মানুষের জীবনের মহত্তম কাজের মধ্যে স্বদেশ অন্যতম একটি। মানব-কল্যাণের মূলেও স্বদেশের প্রতি গভীর মনোযোগ ও ভালোবাসাকেই নির্দেশ করা হয়। উদ্দীপকের লেখকের স্বদেশপ্রেমের বর্ণনা আলোচ্য ‘বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ’ কবিতায় প্রতিফলিত, স্বদেশের প্রতি মেঘনাদ-এর অনুরাগের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। মেঘনাদ সেখানে রামানুজ লক্ষ্মণকে হত্যা করে স্বর্ণলঙ্কার কলঙ্ক ও কালিমা মোচন করতে চেয়েছেন। |
ঘ) উত্তর: উদ্দীপকের মূলভাব এবং ‘বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ’ কবিতায় প্রতিফলিত মেঘনাদের মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা একসূত্রে গাঁথা।-মন্তব্যটি যথার্থ। একজন মানুষের জীবনে তার মা যেমন পরিচিত, তেমনি স্বদেশও পরিচিত। মানুষের সাথে সন্তানের যেরূপ হৃদ্যতা গড়ে ওঠে, দেশের সাথেও তার অনুরূপ হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। একজন মানুষের সামগ্রিক জীবনের বিকাশে তার স্বদেশ প্রকৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুস্থ চিন্তা-চেতনাসম্পন্ন প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই স্বদেশপ্রীতি রয়েছে। উদ্দীপকে স্বদেশের প্রতি মানুষের অনুরাগ প্রসঙ্গে যে বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে তাতে স্বদেশানুরাগের গভীর চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। একজন দেশপ্রেমিক কীভাবে তার দেশের জন্য আত্মত্যাগ করতে পারেন তা সেখানে তুলে ধরা হয়েছে। উদ্দীপকের এই বক্তব্যের চেতনা আলোচ্য ‘বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ’ কবিতায় প্রতিফলিত মেঘনাদের স্বদেশ চেতনার সাথে অভিন্ন ধারায় প্রবাহিত। মেঘনাদ অসীম সাহসী বীর। তিনি তাঁর প্রিয় ভূমিকে মুক্ত করতে চেয়েছেন। স্বর্ণলঙ্কাকে শত্রু কালো থাবার ছায়া থেকে মুক্ত করতে চেয়েছেন। এখানে মেঘনাদ তার আত্মত্যাগের মাধ্যমে প্রিয় জন্মভূমিকে মুক্ত করার স্বপ্ন দেখেছেন। এভাবে উদ্দীপকটির মূলভাব আলোচ্য কবিতায় প্রতিফলিত মেঘনাদের স্বদেশ প্রীতির সাথে একসূত্রে গাঁথা। |