নুরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়

নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
সৈয়দ শামসুল হক


নিলক্ষা আকাশ নীল, হাজার হাজার তারা ঐ নীলে 🔒ব্যাখ্যা অগণিত আর
নিচে গ্রাম, গঞ্জ, হাট, জনপদ, লোকালয় আছে উনসত্তর হাজার। 🔒ব্যাখ্যা
ধবল দুধের মতো জ্যোৎস্না তার ঢালিতেছে চাঁদ-পূর্ণিমার। 🔒ব্যাখ্যা
নষ্ট ক্ষেত, নষ্ট মাঠ, নদী নষ্ট, বীজ নষ্ট, বড় নষ্ট যখন সংসার 🔒ব্যাখ্যা
তখন হঠাৎ কেন দেখা দেয় নিলক্ষার নীলে তীব্র শিস
দিয়ে এত বড় চাঁদ? 🔒ব্যাখ্যা
অতি অকস্মাৎ
স্তব্ধতার দেহ ছিঁড়ে কোন ধ্বনি? কোন শব্দ? কিসের প্রপাত🔒ব্যাখ্যা
গোল হয়ে আসুন সকলে,
ঘন হযে আসুন সকলে, 🔒ব্যাখ্যা
আমার মিনতি আজ স্থির হয়ে বসুন সকলে। 🔒ব্যাখ্যা
অতীত হঠাৎ হাতে হানা দেয় মানুষের বন্ধ দরোজায়। 🔒ব্যাখ্যা
এই তীব্র স্বচ্ছ পূর্ণিমায়
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়। 🔒ব্যাখ্যা
কালঘুম যখন বাংলায় 🔒ব্যাখ্যা
তার দীর্ঘ দেহ নিয়ে আবার নূরলদীন দেখা দেয় মরা আঙিনায়। 🔒ব্যাখ্যা
নূরলদীনের বাড়ি রংপুরে যে ছিল,
রংপুরে নূরলদীন একদিন ডাক দিয়েছিল
১১৮৯ সনে। 🔒ব্যাখ্যা
আবার বাংলার বুঝি পড়ে যায় মনে,
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় 🔒ব্যাখ্যা
যখন শকুন নেমে আসে এই সোনার বাংলায়, 🔒ব্যাখ্যা
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার দেশ ছেয়ে যায় দালালেরই আলখাল্লায়; 🔒ব্যাখ্যা
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় 🔒ব্যাখ্যা
যখন আমার স্বপ্ন লুট হয়ে যায়’
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার কণ্ঠ বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়’
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় 🔒ব্যাখ্যা
যখন আমারই দেশে এ আমার দেহ থেকে রক্ত ঝরে যায়  🔒ব্যাখ্যা
ইতিহাসে, প্রতিটি পৃষ্ঠায়।
আসুন, আসুন তবে, আজ এই প্রশস্ত প্রান্তরে;
যখন স্মৃতির দুধ জ্যোৎস্নার সাথে ঝরে পড়ে, 🔒ব্যাখ্যা
তখন কে থাকে ঘুমে? কে থাকে ভেতরে?
কে একা নিঃসঙ্গ বসে অশ্রুপাত করে?
সমস্ত নদীর অশ্রু অবশেষে ব্রহ্মপুত্রে মেশে। 🔒ব্যাখ্যা
নূরলদীনেরও কথা যেন সারা দেশে
পাহাড়ি ঢলের মতো নেমে এসে সমস্ত ভাষায়, 🔒ব্যাখ্যা
অভাগা মানুষ যেন জেগে ওঠে আবার এ আশায় 🔒ব্যাখ্যা
যে, আবার নূরলদীন একদিন আসিবে বাংলায় , 🔒ব্যাখ্যা
আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায়
দিবে ডাক, 🔒ব্যাখ্যা ‘জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?’ 🔒ব্যাখ্যা

পাঠ-পরিচিতি
‘নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়’ কবিতাটি সৈয়দ শামসুল হকের বিখ্যাত কাব্যনাটক ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ শীর্ষক কাব্যনাটক থেকে সংকলিত হয়েছে। এটি এই নাটকের প্রস্তাবনা অংশ।
নাটকটির প্রস্তাবনা অংশে সূত্রধার আবেগঘন কাব্যিক বর্ণনার মাধ্যমে দর্শকদের সঙ্গে নাট্যকাহিনির সংযোগ স্থাপন করেছেন। নূরলদীন এক ঐতিহাসি চরিত্র। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে সামন্তবাদ-সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সাহসী কৃষকনেতা নূরলদীনের সংগ্রামের কথা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে। সৈয়দ শামসুল হক ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নূরলদীনের সাহস আর ক্ষোভকে অসামান্য নৈপুণ্যে মিশিয়ে দিয়েছেন বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে।
১৯৭১ সালের ২৫ এ মার্চ কালরাত থেকে শুরু করে দীর্ঘ নয় মাস যখন এই বাংলা মৃত্যুপুরীতে রূপ নেয়, যখন শকুনরূপী দালালের আলখাল্লায় ছেয়ে যায় দেশ, যখন বাঙালি হারায় তার স্বপ্ন ও বাক-স্বাধীনতা, যখন স্বজনের রক্তে ভেসে যায় ইতিহাসের প্রতিটি পৃষ্ঠা-তখন মনে পড়ে ইতিহাসের প্রতিবাদী নায়ক নূরলদীনকে-এই চেতনাই কবিতাটিতে সৈয়দ শামসুল হক তুলে ধরতে চেয়েছেন। ১১৮৯ বঙ্গাব্দে (১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দ) নূরলদীনের ডাকে মানুষ যেভাবে জেগে উঠেছিল, এখনও ঠিক সেইভাবে জেগে উঠবে বাংলার জন-মানুষ-এটাই কবির বিশ্বাস। এভাবে কবির শিল্পভাবনায় নূরলদীন ক্রমান্বয়ে এক চিরায়ত প্রতিবাদের প্রতীকে পরিণত হয়। ইতিহাসের পাতা থেকে বেরিয়ে এসে নূরলদীন মিশে যায় বাংলার শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের ভিড়ে-অংশগ্রহণ করে সমকালীন সকল আন্দোলন-সংগ্রামে। তাই কবির মনে হয়-অভাগা মানুষ জেগে উঠে পাহাড়ি ঢলের মতো ভাসিয়ে দেবে অন্যায় যখন নূরলদীন দেবে ডাক-‘জাগো, বাহে, কোনঠে সবাই’।

উত্তর : নীল। 

উত্তর : সৈয়দ শামসুল হক ‘সব্যসাচী লেখক’ লেখক হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।

উত্তর : ‘মরা আঙিনা’ হচ্ছে- মৃত্যু নিথর অঙ্গন।

উত্তর : রংপুর। 

উত্তর : নিলক্ষা শব্দের অর্থ হচ্ছে- দৃষ্টিসীমা অতিক্রমী।


উত্তর : আলোচ্য উক্তিটি দ্বারা আকাশে অসংখ্য তারার অবস্থানকে বোঝানো হয়েছে।
আকাশের  রং নীল। আর সেই নীল রঙের আকাশে ফুটে থাকে অসংখ্য তারা। তারাগুলো জ্বলজ্বল করতে থাকে নীল  আকাশের বুকে। এরকম চিত্রকল্পই উদ্ধৃত পঙ্ক্তিতে প্রকাশ পেয়েছে।



উত্তর : এখানে কবি অতীত স্মৃতিকে বুঝিয়েছেন।
নীল আকাশের হাজার হাজার তারা, সেখানে পূর্ণিমার চাঁদ শোভা পাচ্ছে। নিচে ঊনসত্তর হাজার লোকালয়, হাট-বাজার, গঞ্জ ঘুমে বিভোর স্তব্ধ। এই শান্ত-শান্তিময় জীবনের ওপর পূর্ণিমার চাঁদ ধবল দুধের মতো জ্যোৎস্না ঢেলে দিচ্ছে। প্রকৃতি আর জীবন এখানে আরও মায়াময় হয়ে উঠেছে।


উত্তর : বাংলার অফুরন্ত সৌন্দর্য বিধাতার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। প্রকৃতির মানসকন্যা। 
এখানে নীল আকাশে শোভা পায় হাজার হাজার তারা ও পূর্নিমার চাঁদ। নিচে রয়েছে উনসত্তর হাজার লোকালয়, গ্রাম, গঞ্জ, হাট-জনপদ। রাতে পূর্ণিমার চাঁদ যেন পৃথিবীতে ধবধবে সাদা জোছনার আলো ঢেলে দেয়। তাই কবি পূর্ণিমা চাঁদের জোছনাকে সাদা দুধের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এখানে প্রকৃতিকুল ও প্রাণিকুলের সমন্বয়ে বাংলার শান্তমায়াময় আবহ তুলে ধরা হয়েছে।


উত্তর : এখানে বৃটিশদের অত্যাচারে বাংলার সমাজ-সংসারে অস্থির ও অশান্ত অবস্থাকে বোঝানো হয়েছে।
আবহমানকাল ধরে বাংলার সবুজ প্রকৃতির সৌন্দর্যে ভিনদেশিরা আকৃষ্ট হয়েছে। তারা পাহাড় ডিঙিয়ে, সমুদ্র পাড়ি দিয়ে, মরভূমি অতিক্রম করে এদেশে এসে এখানকার সহজ-সরল মানুষের ওপর নানাভাবে অত্যাচার নির্যাতন চালিয়েছে। এদেশের সমস্ত কিছুতেই নষ্টের বীজ বুনেছে, এদেশের মানুষের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। কবি প্রশ্নোক্ত চরণটিতে শ্যামল বাংলার বিধ্বস্ত রূপটি তুলে ধরেছেন।


উত্তর : এ দেশ, দেশের সম্পদ, মানুষ যখন ধ্বংসের মুখে তখন আকাশে এত বড় স্নিগ্ধ চাঁদ ওঠাকে কবির কাছে সম্ভবনার প্রতীক মনে হয়েছে।
বিভিন্ন সময়ে এ দেশ হিংস্র লোভী ভিনদেশি নরপশুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। তাদের একমাত্র ইচ্ছা এদেশের সম্পদ লুট করা। তাই তারা এদেশের নদী, মাঠ, ফসল, খেত, বীজ সবকিছু তছনছ করে ফেলেছে। দেশের এমন দুঃসময়ে প্রকৃতির এই দুর্দশার মাঝে নীলাকাশে বড় চাঁদ ওঠার মধ্য দিয়ে নতুন আশার সঞ্চার হয় বলে কবি মনে করেন।



Score Board

১) ‘রংপুরে নূরলদীন একদিন ডাক দিয়েছিল

২) নূরলদীনের বাড়ি কোথায়?

৩) ‘তার দীর্ঘ দেহ নিয়ে আবার নূরলদীন দেখা দেয় মরা আঙিনায়’। নূরলদীন দেখা দেয়

৪) ‘নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়’ কবিতায়  কাব্য নাট্যাংশে ‘নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়’ চরণটি ব্যবহৃত হয়েছে

৫) ‘নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়’ কাব্যনাট্যাংশে জ্যোৎস্নার সাথে কী ঝরে পড়ে?

Score Board

উত্তর :

ক) অতীত হঠাৎ হাতে হানা দেয় মানুষের বন্ধ দরজায়।

খ) উল্লিখিত পঙক্তির মাধ্যমে কবি পাকিস্তানি শাসক কর্তৃক বাঙালির বাক স্বাধীনতা হরণকে ইঙ্গিত করেছেন।

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলার মানুষের ওপর নানারকম জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছিল দীর্ঘদিন। এদেশের সাধারণ মানুষ নিরুপায় হয়ে সেসব সহ্য করেছে। তারা প্রতিবাদ করতে পারত না তাদের মত প্রকাশের অধিকারকে কুক্ষিগত করে রাখার জন্য। প্রতিবাদকারীকে তারা কঠোরভাবে দমন করত। এভাবে বাকস্বাধীনতাকে হরণকারীদের প্রতি ক্ষুদ্ধ হয়ে কবি আলোচ্য উক্তিটি করেছেন।

গ) স্বৈরাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার চেতনায় উদ্দীপকের কবিতাংশ ও ‘নূরলদিনের কথা মনে পরে যায়’ কবিতা সাদৃশ্যপূর্ণ।

শাসকরা যখন জনগণের ন্যায্য অধিকার হরণ করে অন্যায়ভাবে তাদের ওপর শোষণ ও নির্যাতন চালায়, তখন তারা স্বৈরাচারী শাসক হিসেবে আখ্যায়িত হয়। মুক্তিকামী জনতা সেই স্বৈরাচারী শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে পারলেই জনগণের বিজয় সূচিত হয়। উদ্দীপকে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী সত্তার আবির্ভাব ঘটানো হয়েছে। যে বিদ্রোহী নিরবধি যুদ্ধ করে যাচ্ছে। কোনো ক্লান্তি শ্রান্তি তাকে স্পর্শ করে না। যতদিন আকাশে-বাতাসে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল বন্ধ হবে না ততদিন তার সংগ্রাম চলবে। অত্যাচারীর খড়গহস্ত ধুলিস্যাৎ না করা পর্যন্ত সেই বিদ্রোহী শান্ত হবে না।সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫) রচিত ‘নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়’ কবিতাটিতে শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠার কথা উচ্চকিত হয়েছে। কবি নূরলদীনকে বিদ্রোহী সত্তার আদর্শ হিসাবে উপস্থাপন করে আমাদের মধ্যে বিদ্রোহের প্রেরণা জাগিয়েছেন। বাংলার দুর্দিনে কবি সকলকে নূরলদীনের মত জেগে ওঠার আহ্বান জাগিয়েছেন।

সুতরাং বলা যায় যে, উদ্দীপকটি কবির এ চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে চেতনাগত সাদৃশ্য স্থাপন করেছে।


ঘ) “উদ্দঈপকটি ‘নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়’ কবিতার সমগ্র চেতনাকে ধারণ করতে পারেনি”মন্তব্যটি একেবারে যথার্থ।

‘নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়’ কবিতার ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালির সকল মুক্তিসংগ্রামে নূরলদীনের মতো বিদ্রোহীসত্তাকে আহ্বান জানানো হয়েছে। অন্যদিকে উদ্দীপকে শুধু শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য আহ্বান জানানোর দিকটি উঠে এসেছে।উদ্দীপকে কবিতাংশের কবি অন্যায়ের বিরুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য বিদ্রোহে বিশ্বাসী। তাঁর চেতনায় এক অসীম সাহসী বীরযোদ্ধা বিচরণ করছে। যে বীর উৎপীরিতের ক্রন্দন শুনতে চায় না, সে বিদ্রোহী অত্যাচারীর খড়গহস্ত ভেঙে দিয়ে মানুষের মুক্তির নেশায় অবিচল।   সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫) রচিত ‘নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়’ কবিতায় সংগ্রামী কৃষকনেতা নূরলদীনের কথা বর্ণিত হয়েছে। যার নেতৃত্ব ১১৮৯ বঙ্গাব্দে রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে। কবির মতে, তাঁর প্রতিবাদী চেতনা বাঙালির সমকালীন সকল আন্দোলন ও সংগ্রামী উৎস। তাছাড়া কবিতায় ১৯৭১ সালের নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের ভয়াল বাস্তবতা বাঙালির বাক-স্বাধীনতা হরণ, শকুনরূপী দালালের আলখাল্লায় ছেয়ে যাওয়া প্রভৃতি উঠে এসেছে।কিন্তু উদ্দীপকের ভাবনায় কেবল কবিমনের প্রবল বিদ্রোহী চেতনার প্রকাশ লক্ষণীয়। তাই বলা যায়, প্রশ্নোক্ত মন্তব্যটি একেবারে যথার্থ।   



উত্তর : _

উত্তর : _