সাহিত্যে খেলা
প্রমথ চৌধুরী
লেখক পরিচিতি:
প্রকৃত নাম : প্রমথ চৌধুরী
ছদ্মনাম : বীরবল
জন্ম ও পরিচয় : ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই আগস্ট যশোরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস পাবনা জেলার হরিপুর গ্রামে।
পিতা : দুর্গাদাস চৌধুরী।
মাতা: সুকুমারী দেবী।
শিক্ষাজীবন :
তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে বি.এ. (অনার্স) দর্শন, ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে এম.এ. ডিগ্রী লাভ করেন এবং লন্ডন থেকে বার এট-ল পাস করেন।
কর্মজীবন : কিছুকাল ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন এবং পরে সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন।
সাহিত্যকর্ম
গদ্যগ্রন্থ: তেল-নুন-লাকড়ি (১৯০৬), বীরবলের হালখাতা (১৯১৬), নানাকথা (১৯১৯), আমাদের শিক্ষা (১৯২০), রায়তের কথা (১৯২৬), নানাচর্চা (১৯৩২), প্রবন্ধ সংগ্রহ (১ম খ-- ১৯৫২ ও ২য় খ-- ১৯৫৩)। ছন্দে ছন্দে গদ্যগ্রন্থ: বন্ধু রায়তের কথায় তেল-নুন-লাকড়ি নিয়ে বীরবলের হালখাতায় গেলাম এবং সেখানে আমাদের শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধ সংগ্রহ নিয়ে নানার চর্চার নানা কথা শুনলাম। কাব্যগ্রন্থ: সনেট পঞ্চাশৎ (১৯১৩) ও পদচারণ (১৯১৯)। গল্পগ্রন্থ: চার ইয়ারী কথা (১৯১৬), আহুতি (১৯১৯), নীল লোহিত ও গল্পসংগ্রহ (১৯৪১)। ছন্দে ছন্দে গল্পগ্রন্থ: নীল লোহিত বাবু চার ইয়ারি দেশের গল্পসংগ্রহ নিয়ে ‘আহুতি’ গল্পগ্রন্থটি রচনা করেন।
বিশেষ কৃতিত্ব :
তিনি বাংলা গদ্যসাহিত্যে চলিত রীতি এবং কাব্যসাহিত্যে ইতালীয় সনেটের প্রবর্তন করেন। পুরস্কারকলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত 'জগত্তারিণী স্বর্ণপদক' লাভ।
জীবনাবসান :
১৯৪৬ সালে ২রা সেপ্টেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
উৎস পরিচিতি:
প্রমথ চৌধুরীর ‘সাহিত্যে খেলা’ প্রবন্ধটি তাঁর ‘প্রবন্ধসংগ্রহ’ বই থেকে নেওয়া হয়েছে। এটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় তাঁর সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার শ্রাবণ ১৩২২ বঙ্গাব্দ (১৯১৫) সংখ্যায়।
জগৎ-বিখ্যাত ফরাসি ভাস্কর রোদ্যাঁ, যিনি নিতান্ত জড় প্রস্তরের দেহ থেকে অসংখ্য জীবিতপ্রায় দেবদানব কেটে বার করেছেন তিনিও শুনতে পাই, যখন তখন হাতে কাদা নিয়ে, আঙুলের টিপে মাটির পুতুল ত'য়ের করে থাকেন।🔒ব্যাখ্যা এই পুতুল গড়া হচ্ছে তাঁর খেলা। 🔒ব্যাখ্যা শুধু রোদ্যাঁ কেন, পৃথিবীর শিল্পী মাত্রেই এই শিল্পের খেলা খেলে থাকেন। 🔒ব্যাখ্যা যিনি গড়তে জানেন, তিনি শিবও গড়তে পারেন, বাঁদরও গড়তে পারেন। 🔒ব্যাখ্যা আমাদের সঙ্গে বড় বড় শিল্পীদের তফাত এইটুকু 🔒ব্যাখ্যা যে, তাদের হাতে এক করতে আর হয় না। সম্ভবত এই কারণে কলারাজ্যের মহাপুরুষদের যা-খুশি তাই করবার যে অধিকার আছে, ইতর শিল্পীদের সে অধিকার নেই। স্বর্গ হতে দেবতারা মধ্যে মধ্যে ভূতলে অবতীর্ণ হওয়াতে কেউ আপত্তি করেন না, কিন্তু মর্তবাসীদের পক্ষে রসাতলে গমন করাটা বিশেষ নিন্দনীয়। অথচ একথা অস্বীকার করবার জো নেই যে, যখন এ জগতে দশটা দিক আছে তখন সেই সব দিকেই গতায়াত করবার প্রবৃত্তিটি মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক। মন উঁচুতেও উঠতে চায়, নিচুতেও নামতে চায়। 🔒ব্যাখ্যা বরং সত্য কথা বলতে গেলে সাধারণ লোকের মন স্বভাবতই যেখানে আছে তারই চারপাশে ঘুরে বেড়াতে চায়, উড়তেও চায় না ডুবতেও চায় না। কিন্তু সাধারণ লোকে সাধারণ লোককে কী ধর্ম, কী নীতি, কী কাব্য, সকল রাজ্যেই অহরহ ডানায় ভর দিয়ে থাকতেই পরামর্শ দেয় । একটু উঁচুতে না চড়লে আমরা দর্শক এবং শ্রোতৃমণ্ডলীর নয়ন মন আকর্ষণ করতে পারি নে। 🔒ব্যাখ্যা বেদীতে না বসলে আমাদের উপদেশ কেউ মানে না। 🔒ব্যাখ্যা রঙ্গমঞ্চে না চড়লে আমাদের অভিনয় কেউ দেখে না, 🔒ব্যাখ্যা আর কাষ্ঠমঞ্চে না দাঁড়ালে আমাদের বক্তৃতা কেউ শোনে না। সুতরাং জনসাধারণের চোখের সম্মুখে থাকবার লোভে আমরাও অগত্যা চব্বিশ ঘণ্টা টঙে চড়ে থাকতে চাই, 🔒ব্যাখ্যা কিন্তু পারি নে। অনেকের পক্ষে নিজেদের আয়ত্তের বহির্ভূত উচ্চস্থানে ওঠবার চেষ্টাটাই মহাপতনের কারণ হয়। 🔒ব্যাখ্যা এসব কথা বলবার অর্থ এই যে, কষ্টকর হলেও আমাদের পক্ষে অবশ্য মহাজনদের পথ অনুসরণ করাই কর্তব্য। কিন্তু ডাইনে-বাঁয়ে ছোটখাট গলিঘুঁজিতে খেলাচ্ছলে প্রবেশ করবার যে অধিকার তাদের আছে, সে অধিকারে আমরা কেন বঞ্চিত হব। গান করতে গেলেই যে সুর তারায় চড়িয়ে রাখতে হবে, কবিতা লিখতে হলেই যে মনের শুধু গভীর ও প্রখর ভাব প্রকাশ করতে হবে, এমন কোনো নিয়ম থাকা উচিত নয়। শিল্পরাজ্যে খেলা করবার প্রবৃত্তির ন্যায় অধিকারও বড়-ছোট সকলের সমান আছো ৷ 🔒ব্যাখ্যা এমনকি, একথা বললেও অত্যুক্তি হয় না যে, এ পৃথিবীতে একমাত্র খেলার ময়দানে ব্রাহ্মণশূদ্রের প্রভেদ নেই। 🔒ব্যাখ্যা রাখাল ছেলের সঙ্গে দরিদ্রের ছেলেরও খেলায় যোগ দেবার অধিকার আছে। আমরা যদি একবার সাহস করে কেবলমাত্র খেলা করবার জন্য সাহিত্যজগতে প্রবেশ করি, 🔒ব্যাখ্যা তাহলে নির্বিবাদে সে জগতের রাজ-রাজড়ার দলে মিশে যাব। 🔒ব্যাখ্যা কোনোরূপ উচ্চ আশা নিয়ে সে ক্ষেত্রে উপস্থিত হলেই নিম্নশ্রেণিতে পড়ে যেতে হবে।
লেখকেরাও অবশ্য দশের কাছে হাততালির প্রত্যাশা রাখেন, বাহবা না পেলে মনঃক্ষুণ্ণ হন। কেননা তারাই হচ্ছেন যথার্থ সামাজিক জীব, 🔒ব্যাখ্যা বাদবাকি সকলে কেবলমাত্র পারিবারিক। বিশ্বমানবের মনের সঙ্গে নিত্য নূতন | সম্বন্ধ পাতানোই হচ্ছে কবিমনের নিত্যনৈমিত্তিক কর্ম। 🔒ব্যাখ্যা এমনকি, কবির আপন মনের গোপন কথাটিও গীতিকবিতাতে রঙ্গভূমির স্বগতোক্তি স্বরূপেই উচ্চারিত হয়, যাতে করে সেই মর্মকথা হাজার লোকের কানের ভিতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু উচ্চমঞ্চে আরোহণ করে উচ্চৈঃস্বরে উচ্চবাক্য না করলে যে জনসাধারণের নয়ন-মন আকর্ষণ করা যায় না, এমন কোনো কথা নেই। সাহিত্যজগতে যাঁদের খেলা করবার প্রবৃত্তি আছে, সাহস আছে, ক্ষমতা আছে, মানুষের নয়ন-মন আকর্ষণ করবার সুযোগ বিশেষ করে তাদের কপালেই ঘটে। মানুষ যে খেলা দেখতে ভালোবাসে তার পরিচয় তো আমরা জড় সমাজেও নিত্য পাই । টাউনহলে বক্তৃতা শুনতেই বা ক'জন যায় আর গড়ের মাঠে ফুটবল খেলা দেখতেই বা ক'জন যায়। 🔒ব্যাখ্যা অথচ এ কথাও সত্য যে, টাউনহলের বক্তৃতার উদ্দেশ্য অতি মহৎ, আর গড়ের মাঠের খেলোয়াড়দের ছুটোছুটি, দৌড়াদৌড়ি আগাগোড়া অর্থশূন্য এবং উদ্দেশ্যবিহীন। আসল কথা এই যে, মানুষের দেহমনের সকল প্রকার ক্রিয়ার মধ্যে ক্রীড়া শ্রেষ্ঠ, 🔒ব্যাখ্যা কেননা তা উদ্দেশ্যহীন । মানুষে যখন খেলা করে, তখন সে এক আনন্দ ব্যতীত অপর কোনো ফলের আকাঙ্ক্ষা রাখে না। যে খেলার ভিতর আনন্দ নেই কিন্তু উপরি পাওনার আশা আছে, তার নাম খেলা নয়, , জুয়াখেলা। 🔒ব্যাখ্যা এবং যেহেতু খেলার আনন্দ নিরর্থক অর্থাৎ অর্থগত নয়, সে কারণে তা কারও নিজস্ব হতে পারে না। এ আনন্দে সকলেরই অধিকার সমান।
সুতরাং সাহিত্যে খেলা করবার অধিকার যে আমাদের আছে, শুধু তাই নয়, স্বার্থ এবং পরার্থ এ দুয়ের যুগপৎ সাধনের জন্য মনোজগতে খেলা করাই হচ্ছে আমাদের পক্ষে সর্বপ্রধান কর্তব্য । যে লেখক সাহিত্য ক্ষেত্রে ফলের চাষ করতে ব্রতী হন, যিনি কোনোরূপ কার্য-উদ্ধারের অভিপ্রায়ে লেখনী ধারণ করেন, তিনি গীতের মর্মও বোঝেন না, গীতার ধর্মও বোঝেন না। 🔒ব্যাখ্যা কেননা খেলা হচ্ছে জীবজগতে একমাত্র নিষ্কাম কর্ম, 🔒ব্যাখ্যা অতএব মোক্ষলাভের একমাত্র উপায়। স্বয়ং ভগবান বলেছেন, যদিচ তার কোনোই অভাব নেই তবুও তিনি এই বিশ্ব সৃজন করেছেন, অর্থাৎ সৃষ্টি তাঁর লীলামাত্র । কবির সৃষ্টিও এই বিশ্ব সৃষ্টির অনুরূপ, 🔒ব্যাখ্যা সে সৃজনের মূলে কোনো অভাব দূর করবার অভিপ্রায় নেই—সে সৃষ্টির মূল অন্তরাত্মার স্ফূর্তি আর তার ফল আনন্দ। এক কথায় সাহিত্য সৃষ্টি জীবাত্মার লীলামাত্র এবং সে লীলা বিশ্বলীলার অন্তর্ভূত; কেননা জীবাত্মা পরমাত্মার অঙ্গ এবং অংশ। 🔒ব্যাখ্যা সাহিত্যের উদ্দেশ্য সকলকে আনন্দ দেওয়া, 🔒ব্যাখ্যা কারও মনোরঞ্জন করা নয়। 🔒ব্যাখ্যা এ দুয়ের ভিতর যে আকাশ-পাতাল প্রভেদ আছে, সেইটি ভুলে গেলেই লেখকেরা নিজে খেলা না করে পরের জন্যে খেলনা তৈরি করতে বসেন।
সমাজের মনোরঞ্জন করতে গেলে সাহিত্য যে স্বধর্মচ্যুত হয়ে পড়ে, 🔒ব্যাখ্যা তার প্রমাণ বাংলাদেশে আজ দুর্লভ নয়। কাব্যের ঝুমঝুমি, বিজ্ঞানের চুষিকাঠি, দর্শনের বেলুন, রাজনীতির রাঙালাঠি, ইতিহাসের ন্যাকড়ার পুতুল, 🔒ব্যাখ্যা নীতির টিনের ভেঁপু এবং ধর্মের জয়ঢাক—এইসব জিনিসে সাহিত্যের বাজার ছেয়ে গেছে। সাহিত্যরাজ্যে খেলনা পেয়ে পাঠকের মনতুষ্টি হতে পারে, কিন্তু তা গড়ে লেখকের মনতুষ্টি হতে পারে না। কারণ পাঠক সমাজ যে খেলনা আজ আদর করে, কাল সেটিকে ভেঙে ফেলে। 🔒ব্যাখ্যা সে প্রাচ্যই হোক আর পাশ্চাত্যই হোক, কাশীরই হোকআর জার্মানিরই হোক দুদিন ধরে তা কারও মনোরঞ্জন করতে পারে না। আমি জানি যে, পাঠক সমাজকে আনন্দ দিতে গেলে তারা প্রায়শই বেদনা বোধ করে থাকেন। কিন্তু এতে ভয় পাবার কিছুই নেই; কেননা কাব্যজগতে যার নাম আনন্দ, তারই নাম বেদনা। 🔒ব্যাখ্যা
অপর পক্ষে এ যুগে পাঠক হচ্ছে জনসাধারণ, সুতরাং তাদের মনোরঞ্জন করতে হলে আমাদের অতি সস্তা খেলনা 🔒ব্যাখ্যা গড়তে হবে, নইলে তা বাজারে কাটবে না। এবং সস্তা করার অর্থ খেলো করা। বৈশ্য লেখকের পক্ষেই শূদ্র পাঠকের মনোরঞ্জন করা সংগত। অতএব সাহিত্যে আর যাই কর-না কেন, পাঠক সমাজের মনোরঞ্জন করবার চেষ্টা কোরো না। 🔒ব্যাখ্যা
তবে কি সাহিত্যের উদ্দেশ্য লোককে শিক্ষা দেওয়া? অবশ্য নয়। 🔒ব্যাখ্যা কেননা কবির মতিগতি শিক্ষকের মতিগতির সম্পূর্ণ বিপরীত 🔒ব্যাখ্যা স্কুল না বন্ধ হলে যে খেলার সময় আসে না, এ তো সকলেরই জানা কথা । কিন্তু সাহিত্য রচনা যে আত্মার লীলা, এ কথা শিক্ষকেরা স্বীকার করতে প্রস্তুত নন। 🔒ব্যাখ্যা সুতরাং শিক্ষা ও সাহিত্যের ধর্মকর্ম যে এক নয়, এ সত্যটি একটু স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেওয়া আবশ্যক। প্রথমত শিক্ষা হচ্ছে সেই বস্তু যা লোকে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও গলাধঃকরণ করতে বাধ্য হয়, অপর পক্ষে কাব্যরস লোকে শুধু স্বেচ্ছায় নয়, সানন্দে পান করে; কেননা শাস্ত্রমতে সে রস অমৃত। 🔒ব্যাখ্যা দ্বিতীয়ত শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের মনকে বিশ্বের খবর জানানো, সাহিত্যের উদ্দেশ্য মানুষের মনকে জাগানো; 🔒ব্যাখ্যা কাব্য যে সংবাদপত্র নয়, একথা সকলেই জানেন। তৃতীয়ত অপরের মনের অভাব পূর্ণ করবার উদ্দেশ্যেই শিক্ষকের হস্তে শিক্ষা জন্মলাভ করেছে, কিন্তু কবির নিজের মনের পরিপূর্ণতা হতেই সাহিত্যের উৎপত্তি। সাহিত্যের উদ্দেশ্য যে আনন্দদান করা, শিক্ষা দান করা নয়, একটি উদাহরণের সাহায্যে তার অকাট্য প্রমাণ দেওয়া যেতে পারে।
বাল্মীকি আদিতে মুনি-ঋষিদের জন্য রামায়ণ রচনা করেছিলেন, জনগণের জন্য নয়। 🔒ব্যাখ্যা এ কথা বলা বাহুল্য যে, বড় বড় মুনি-ঋষিদের কিঞ্চিৎ শিক্ষা দেওয়া তার উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু রামায়ণ শ্রবণ করে মহর্ষিরাও যে কতদূর আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলেন তার প্রমাণ তাঁরা কুশীলবকে তাঁদের যথাসর্বস্ব, এমনকি কৌপীন পর্যন্ত পেলা দিয়েছিলেন। রামায়ণ কাব্য হিসেবে যে অমর এবং জনসাধারণ আজও যে তার শ্রবণে পঠনে আনন্দ উপভোগ করে তার একমাত্র কারণ, আনন্দের ধর্মই এই যে তা সংক্রামক। 🔒ব্যাখ্যা অপর পক্ষে লাখে একজনও যে যোগবশিষ্ঠ রামায়ণের ছায়া মাড়ান না তার কারণ, সে বস্তু লোককে শিক্ষা দেবার উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছিল, আনন্দ দেবার জন্য নয়। আসল কথা এই যে, সাহিত্য কস্মিনকালেও স্কুলমাস্টারির ভার নেয়নি। এতে দুঃখ করবার কোনো কারণ নেই। দুঃখের বিষয় এই যে, স্কুলমাস্টারেরা একালে সাহিত্যের ভার নিয়েছেন।
কাব্যরস নামক অমৃতে যে আমাদের অরুচি জন্মেছে, 🔒ব্যাখ্যা তার জন্য দায়ী এ যুগের স্কুল এবং তার মাস্টার। কাব্য পড়বার ও বোঝবার জিনিস, কিন্তু স্কুলমাস্টারের কাজ হচ্ছে বই পড়ানো ও বোঝানো। লেখক এবং পাঠকদের মধ্যে এখন স্কুলমাস্টার দণ্ডায়মান। 🔒ব্যাখ্যা এই মধ্যস্থদের কৃপায় আমাদের সঙ্গে কবির মনের মিলন দূরে থাক, চার চক্ষুর মিলনও ঘটে না। স্কুলঘরে আমরা কাব্যের রূপ দেখতে পাই নে, 🔒ব্যাখ্যা শুধু তার গুণ শুনি। টীকা-ভাষ্যের প্রসাদে আমরা কাব্য সম্বন্ধে সকল নিগূঢ় তত্ত্ব জানি, কিন্তু সে কী বস্তু তা চিনিনে। আমাদের শিক্ষকদের প্রসাদে আমাদের এ জ্ঞান লাভ হয়েছে যে, পাথুরে কয়লা হীরার সবর্ণ না হলেও সগোত্র; অপর পক্ষে হীরক ও কাচ যমজ হলেও সহোদর নয়। এর একের জন্ম পৃথিবীর গর্ভে অপরটি | মানুষের হাতে; এবং এ উভয়ের ভিতর এক দা-কুমড়ার সম্বন্ধ ব্যতীত অপর কোনো সম্বন্ধ নেই। অথচ এত জ্ঞান সত্ত্বেও আমরা সাহিত্যে কাচকে হীরা এবং হীরাকে কাচ বলে নিত্য ভুল করি, এবং হীরা ও কয়লাকে একশ্রেণিভুক্ত করতে| তিলমাত্র দ্বিধা করিনে, কেননা ওরূপ করা যে সঙ্গত তার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আমাদের মুখস্থ আছে | সাহিত্য শিক্ষার ভার নেয় না, 🔒ব্যাখ্যা কেননা মনোজগতে শিক্ষকের কাজ হচ্ছে কবির কাজের ঠিক উলটো। 🔒ব্যাখ্যা কারণ কবির কাজ হচ্ছে কাব্য সৃষ্টি করা, আর শিক্ষকের কাজ হচ্ছে প্রথমে তা বধ করা, তারপরে তার শবচ্ছেদ করা, এবং ঐ উপায়ে তার তত্ত্ব আবিষ্কার করা ও প্রচার করা । এই সব কারণে নির্ভয়ে বলা যেতে পারে যে, কারও মনোরঞ্জন করাও সাহিত্যের কাজ নয় । কাউকে শিক্ষা দেওয়াও নয়। সাহিত্য ছেলের হাতের খেলনাও নয়, গুরুর হাতের বেতও নয়। 🔒ব্যাখ্যা
বিচারের সাহায্যে এই মাত্রই প্রমাণ করা যায়। তবে বস্তু যে কী, তার জ্ঞান অনুভূতিসাপেক্ষ তর্কসাপেক্ষ নয়। সাহিত্যে মানবাত্মা খেলা করে এবং সেই খেলার আনন্দ উপভোগ করে। এ কথার অর্থ যদি স্পষ্ট না হয় তাহলে কোনো সুদীর্ঘ ব্যাখ্যার দ্বারা তা স্পষ্টতর করা আমার অসাধ্য।
এই সব কথা শুনে আমার জনৈক শিক্ষাভক্ত বন্ধু এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, সাহিত্য খেলাচ্ছলে শিক্ষা দেয়।
মূলভাব
প্রমথ চৌধুরীর ‘সাহিত্যে খেলা’ প্রবন্ধটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার শ্রাবণ ১৩২২ বঙ্গাব্দ (১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দ) সংখ্যায়। পরে তা তাঁর ‘প্রবন্ধসংগ্রহ’ (১৯৫২) বইয়ে সংকলিত হয়। এই প্রবন্ধে সাহিত্যচর্চার আদর্শ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে লেখকের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গির সুস্পষ্ট পরিচয় ফুটে উঠেছে।
লেখাটি ঈষৎ সংক্ষেপিত আকারে এখানে মুদ্রিত হয়েছে। প্রমথ চৌধুরীর মতে, সাহিত্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে সকলকে আনন্দ দান করা, কারও মনোরঞ্জন করা নয়। সমাজের মনোরঞ্জন করতে গেলে সাহিত্য হয়ে পড়বে স্বধর্মচ্যুত। অন্যদিকে সাহিত্যের উদ্দেশ্য শিক্ষা দান করাও নয়। কারণ পাঠ্যবিষয় মানুষ পড়ে অনিচ্ছায় এবং বাধ্য হয়ে। পক্ষান্তরে সাহিত্যের রসাস্বাদন করে মানুষ স্বেচ্ছায় ও আনন্দে। তাছাড়া শিক্ষার উদ্দেশ্য জ্ঞানের বিষয় জানানো; পক্ষান্তরে সাহিত্যের উদ্দেশ্য মানুষের মনে সাড়া জাগানো। লেখকের মতে, সাহিত্যের সঙ্গে তুলনা চলে খেলাধুলার। খেলাধুলায় যেমন নিছক আনন্দই প্রধান, সাহিত্যেও তাই। খেলাধুলায় যেমন আনন্দ ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই, সাহিত্যের উদ্দেশ্যও তেমনি- একমাত্র আনন্দ দান করা।
১) ‘পরার্থ’ শব্দের অর্থ কোনটি?
২) লেখকের মতে, সাহিত্যের উদ্দেশ্য কোনটি?
৩) সাহিত্য ‘স্বধর্মচ্যুত’ হয় তখন, যখন সাহিত্যচর্চা হয়-
৪) ‘সাহিত্যে খেলা’ প্রবন্ধে অনুচ্ছেদটির ‘জ্ঞানের কথা’র সমার্থক ভাব হলো-
৫) ‘সাহিত্যে খেলা’ প্রবন্ধ অনুসারে সাহিত্যের উদ্দেশ্য কী?
ক) ‘রামায়ণ’ বিখ্যাত ঋষি ও কবি বাল্মীকি রচনা করেছেন। |
খ) পাঠকের মনস্তুষ্টির জন্য যে সাহিত্য রচিত হয় “অতি সস্তা খেলনা” বলতে তা-ই বোঝানো হয়েছে। বর্তমান যুগে পাঠক হচ্ছে জনসাধারণ, তাই তাদের মনোরঞ্জনের জন্য খেলনা গড়তে হবে, তা না হলে বাজারে কাটবে না। কিন্তু খেলনা গড়ে পাঠকের মনস্তুষ্টি হলেও লেখকের মনস্তুষ্টি হতে পারে না। কারণ পাঠকসমাজ যে খেলনা আজ আদর করে তা ভেঙে ফেলে। এজন্য শুধু পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্য সৃষ্ট/রচিত সাহিত্যকে অতি সস্তা খেলনা' বলা হয়েছে। |
গ) সাহিত্যের মাধ্যমে শুধু লোকের হিতসাধন ও সন্তুষ্টির চেষ্টা করা হলে ‘সাহিত্যের স্বধর্মচ্যুতি’ হয়, কথাটি অনুচ্ছেদে প্রতিফলিত হয়েছে। সাহিত্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে সবাইকে আনন্দদান করা, কারও মনোরঞ্জন করা নয়। সমাজের মনোরঞ্জন করতে গেলে সাহিত্য হয়ে পড়বে স্বধর্মচ্যুত। সাহিত্য রচনা করার সময় লেখকের এই বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হয়। অনুচ্ছেদে দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা হয়েছে, সূর্য পূর্বাকাশে ওঠে -এই তথ্য আমাদের মনকে আকর্ষণ করে না। কিন্তু সূর্যোদয়ে যে সৌন্দর্য ও দেখার আনন্দ তা সৃষ্টিকাল থেকে আজও বিদ্যমান। এই সৌন্দর্য ও আনন্দানুভূতি পাঠকহৃদয়ে জাগিয়ে তোলাই সাহিত্যের কাজ। সাহিত্যের সৌন্দর্যানুভূতি যদি কারও মনোরঞ্জন বা হিতসাধন করে তাতে সাহিত্যের ধর্ম নষ্ট হয় না । কিন্তু যদি শুধু লোকের হিতসাধন ও সন্তুষ্টির জন্য সাহিত্য সৃষ্টি করা হয় তবে সেই সাহিত্য হয়ে পড়বে কুলত্যাগী। এই ধরনের সাহিত্য অধিক সস্তা খেলনার মতো ‘সাহিত্যের স্বধর্মচ্যুত’ হওয়ার বিষয়টি উপরের অনুচ্ছেদে এভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে। |
ঘ) ‘শিক্ষা ও সাহিত্যের উদ্দেশ্য ভিন্নধর্মী’- বক্তব্যটি উপরের অনুচ্ছেদে অনেকখানি প্রতিফলিত হয়েছে বলে আমি মনে করি। শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের মাঝে বিশ্বের খবর পৌছানো। অন্যের মনের অভাব দূর করতেই শিক্ষকের হাতে শিক্ষা জন্মলাভ করেছে। কিন্তু নিজের মনের পরিপূর্ণতা থেকেই সাহিত্যিক তার সাহিত্য সৃষ্টি করেন। সাহিত্যের জগৎ নিছক আনন্দের জগৎ। সাহিত্য হচ্ছে আনন্দের উপকরণ। কাউকে শিক্ষা দান করা এটির উদ্দেশ্য নয়। কাজেই শিক্ষা ও সাহিত্যের ধর্ম-কর্ম যে এক নয়- এই সত্যটি স্পষ্ট হওয়া দরকার। প্রথমত, শিক্ষা অনিচ্ছা সত্ত্বেও গলাধঃকরণ করতে মানুষ বাধ্য হয়, পক্ষান্তরে কাব্যরস লোকে সানন্দে পান করে। কেননা শাস্ত্রমতে সেই রস অমৃত। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের মনকে বিশ্বের খবর জানানো, সাহিত্যের উদ্দেশ্য মানুষের মনকে জাগানো। তৃতীয়ত, অপরের মনের অভাব পূর্ণ করার উদ্দেশ্যেই শিক্ষকের হাতে শিক্ষা জন্মলাভ করেছে, কিন্তু কবির নিজের মনের পরিপূর্ণতা থেকেই সৃষ্টি হয় সাহিত্য। তাই প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, সাহিত্যের উদ্দেশ্য আনন্দদান করা, শিক্ষা দান করা নয়। অনুচ্ছেদেও বক্তব্যটি অনেকখানি প্রতিফলিত হয়েছে। অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জ্ঞানের কথা জেনে মনে আনন্দ জন্মে না। সূর্য পূর্বাকাশে ওঠে- এই তথ্য আমাদের মন টানে না। কিন্তু সূর্যোদয়ে যে সৌন্দর্য ও দেখার আনন্দ আছে তা সৃষ্টিকাল থেকে আজও বিদ্যমান। এই সৌন্দর্য ও আনন্দানুভূতি পাঠক হৃদয়ে জাগিয়ে তোলাই সাহিত্যের কাজ । কাজেই শিক্ষা ও সাহিত্যের উদ্দেশ্য যে ভিন্নধর্মী তা অনুচ্ছেদে অনেকখানি প্রতিফলিত হয়েছে। |
ক) রোদ্যাঁর একটি শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্যের নাম ‘নরকের দুয়ার।’ |
খ) ক্রীড়া উদ্দেশ্যহীন বলে মানুষের দেহ-মনের সকল প্রকার ক্রিয়ার মধ্যে ক্রীড়া শ্রেষ্ঠ। ক্রীড়া হচ্ছে সম্পূর্ণ আনন্দের ব্যাপার। মানুষ যখন খেলা করে, তখন সে একমাত্র আনন্দ ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য বা ফলের আকাক্সক্ষা রাখে না। যে খেলার মধ্যে আনন্দ নেই কিন্তু উপরি কোনো আশা আছে, সেটাকে লেখক খেলা নয়, জুয়াখেলা বলেছেন। যেহেতু খেলার আনন্দ নিরর্থক অর্থগত নয়, সেই কারণে সেটা কারও নিজস্ব হতে পারে না। এই আনন্দে সবার সমান অধিকার। |
গ ) উদ্দীপকে ‘সাহিত্যে খেলা’ প্রবন্ধের ব্রাহ্মণশূদ্রের মানবাধিকার দিকটি প্রতিফলিত হয়েছে। শিল্পরাজ্যে খেলা করার প্রবৃত্তির মতো অধিকারও ছোট-বড় সবার সমান আছে। এই পৃথিবীতে একমাত্র খেলার ময়দানে ব্রাহ্মণ- শূদ্রের প্রভেদ নেই। রাজার ছেলের সঙ্গে দরিদ্রের ছেলেরও খেলায় যোগ দেওয়ার অধিকার আছে। অনুচ্ছেদে শিল্পরাজ্যে মানবাধিকারের কথা বলা হয়েছে। এখানে জাতপাত বিচার করা হয় না। রাজার ছেলেও সাহিত্য রচনা করে, ছবি এঁকে তার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে, আবার প্রজা বা দরিদ্র ঘরের ছেলেও তা করতে পারে। এখানে ব্রাহ্মণ- শূদ্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। প্রবন্ধে খেলার মাঠে এই মানবাধিকারের কথা বলা হয়েছে। পৃথিবীতে একমাত্র খেলার ময়দানে ব্রাহ্মণ-শূদ্রের প্রভেদ নেই। রাজার ছেলের সঙ্গে দরিদ্রের ছেলেরও খেলায় যোগ দেওয়ার অধিকার আছে। এভাবে উদ্দীপকের বক্তব্যটিতে প্রতীয়মান হয় যে খেলার ময়দানে যেমন ব্রাহ্মণ-শূদ্র, শিল্পরাজ্যেও তাদের একই অধিকার প্রতিষ্ঠিত। |
ঘ) উপরের অনুচ্ছেদের ‘লক্ষ হৃদয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষা' বাক্যাংশ অবলম্বনে ‘সাহিত্যে খেলা’ প্রবন্ধে বর্ণিত ‘বিশ্বমানবের সঙ্গে সম্বন্ধ পাতানোরই নামান্তর’ মন্তব্যটি যথার্থ। সাহিত্যের জগৎ -মূলত নিছক আনন্দের জগৎ। মহৎ কবির সৃষ্টি সর্বজনীন আবেদনে পরিপূর্ণ। তার মানসসত্তা প্রতিনিয়তই বিশ্বমানব সত্তা ও সভ্যতার সাথে নিত্যনতুন সংযোগ সাধনের সেতু নির্মাণ করে। মানুষ নিজেকে প্রকাশ করতে চায়। জয়নুল আবেদীনের মতো ছবি এঁকে, রবীন্দ্রনাথের মতো কবিতা ও গান লিখে নিজের হৃদয়ানুভূতি ও রূপচেতনা সে অন্য মনে ছড়িয়ে দিতে চায়। এভাবে সে বিশ্বমানবের সঙ্গে সম্বন্ধ গড়ে তুলতে চায় এবং বেঁচে থাকতে চায় লক্ষ হৃদয়ের মাঝে । উদ্দীপক ও ‘সাহিত্যে খেলা’ প্রবন্ধে মানুষের শিল্পরাজ্যে প্রবেশ করার উদ্দেশ্যটি স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। মহৎ কবিরা সাধারণের মতো আত্মকেন্দ্রিক নন। তাঁরা সর্বজনীন এবং বিশ্বনাগরিক। একজন মহৎ কবির মনে প্রতিনিয়ত যে ভাবের উদয় হয়, সেই ভাবকে তিনি কবিতার মাধ্যমে চিত্রিত করে ছড়িয়ে দেন বিশ্ববাসীর কাছে। ফলে কবিমনের সঙ্গে বিশ্বমানবের নতুন সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। কবির মনের কথাগুলো অসংখ্য পাঠকের মনে প্রবেশ করে। এটার একটাই লক্ষ্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকা। এ দিক থেকে প্রশ্নোক্ত মন্তব্যটি যথার্থ। |
ক) এ পৃথিবীতে ব্রাহ্মণশূদ্রের প্রভেদ নেই খেলার ময়দানে। |
খ) “যে খেলার ভিতর আনন্দ নেই কিন্তু উপরি পাওনার আশা আছে, তার নাম খেলা নয়, জুয়াখেলা।” এ কথা বলতে বৈষয়িক উদ্দেশ্য সাধনে রচিত সাহিত্যকে বোঝানো হয়েছে। খেলাধুলা ও সাহিত্য দুটোরই আনন্দ ভিন্ন অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। তবে খেলার মধ্যে অনেকের কাছে অর্থলাভের চিন্তা প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। তখন সেটাকে আর খেলা বলা হয় না, বলা হয় জুয়াখেলা। সাহিত্যও তেমনই অর্থলাভ বা মনোরঞ্জনের বিষয় নয়। যদি সেখানে কোনো উদ্দেশ্য কাজ করে তাহলে সাহিত্য হয়ে যাবে জুয়াখেলার মতো। ‘সাহিত্যে খেলা' প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক এই কথাটিই জুয়াখেলার উদাহরণ দিয়ে সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন। |
গ) উদ্দীপকের বেলুমামা ‘সাহিত্যে খেলা' প্রবন্ধের স্কুলমাস্টার চরিত্রের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। সাহিত্য হলো আনন্দ উপভোগ করার একটি মাধ্যম। মানুষ সাহিত্যিকের কাছ থেকে আনন্দ ভিন্ন অন্য কিছু কামনা করবে না। মানুষ তাই সাহিত্য পাঠ করবে স্বেচ্ছায়। অন্যদিকে মানুষকে শিক্ষা দান করতে হয় জোর করে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। স্কুলমাস্টাররা যেমন সব বিষয়ই শিক্ষার্থীদের জোর করে বোঝাতে চান, তেমনই উদ্দীপকেও বেলুমামা জোর করে শেখাতে চান। বেলুমামা শিশুদের খেলাধুলা বাদ দিয়ে পড়ালেখা করার কথা বলেন। শিশুরা তখন শিক্ষালাভের বিপরীতে মনের আনন্দে খেলা করার বিষয়টি গ্রহণ করে। ‘সাহিত্যে খেলা' প্রবন্ধেও লেখক স্কুলমাস্টারদের সম্বন্ধে এই কথাগুলোই বলেছেন। তারাও শিক্ষার্থীদের মনের আনন্দকে প্রাধান্য না দিয়ে জোরপূর্বক পড়ালেখায় ব্যস্ত রাখতে চান। এ দিক থেকে উদ্দীপকের বেলুমামা ও ‘সাহিত্যে খেলা' প্রবন্ধের স্কুলমাস্টারদের একই কাতারে ফেলা যায়। |
ঘ) ‘সাহিত্যে খেলা' প্রবন্ধে বর্ণিত সাহিত্যের উদ্দেশ্য এবং উদ্দীপকের শিশুদের খেলার উদ্দেশ্য অভিন্ন। মন্তব্যটি যথার্থ। সাহিত্যের উদ্দেশ্য মানুষকে নির্মল আনন্দদান। এই পৃথিবীতে সাহিত্যের মতো শুধু আনন্দের উদ্দেশ্যে একটা কাজই করা হয়, তা হলো খেলা। খেলার মধ্যে শুধু আনন্দই আছে, অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। ‘সাহিত্যে খেলা' প্রবন্ধে লেখক সাহিত্যের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে মনের আনন্দের বিষয়টি উল্লেখ করেন। তার মতে আনন্দই সাহিত্যের একমাত্র উদ্দেশ্য। সাহিত্যিকরা মনের আনন্দে সাহিত্য রচনা করবেন এবং পাঠক তা পড়ে আনন্দলাভ করবে। উদ্দীপকের শিশুদের খেলায়ও একই উদ্দেশ্য দেখা যায়। শিশুরা মনের আনন্দে খেলা করছে। ‘সাহিত্যে খেলা' প্রবন্ধে সাহিত্যের উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক নিছক আনন্দলাভের কথা বলেছেন। উদ্দীপকে শিশুদের খেলায়ও একই উদ্দেশ্য লক্ষ করি। শুধু আনন্দলাভের উদ্দেশ্যেই তারা খেলাধুলায় মগ্ন হয়। 'সাহিত্যে খেলা' প্রবন্ধ ও উদ্দীপকের শিশুদের খেলা থেকে সাহিত্য ও খেলার একটাই উদ্দেশ্য পাই, তা হলো আনন্দলাভ করা। তাই বলা যায়, সাহিত্যে খেলা' প্রবন্ধে বর্ণিত সাহিত্যের উদ্দেশ্য এবং উদ্দীপকের শিশুদের খেলার উদ্দেশ্য অভিন্ন । সুতরাং উক্তিটি যুক্তিসংগত ও সঠিক। |
ক) 'সাহিত্য নামক অমৃতে যে আমাদের অরুচি জন্মেছে' তার জন্য লেখক এ যুগের স্কুল ও তার মাস্টারকে দায়ী করেছেন। |
খ) “কাব্যের ঝুমঝুমি, বিজ্ঞানের চুষিকাঠি, দর্শনের বেলুন, ইতিহাসের ন্যাকড়ার পুতুল" কথাগুলো দিয়ে প্রমথ চৌধুরী বোঝাতে চেয়েছেন- সাহিত্যের বাজার আজ এসব জিনিসে ছেয়ে গেছে। সাহিত্যের উদ্দেশ্য সবাইকে আনন্দদান করা, কারও মনোরঞ্জন করা নয়। তাই সাহিত্য যদি সমাজের মনোরঞ্জন করতে যায় তবে যে তা স্বধর্মচ্যুত হয়ে পড়ে তার প্রমাণও বাংলাদেশে আজ কম নয়। কারণ পাঠকসমাজ যে খেলনা আজ আদর করে, কাল সেটিকে ভেঙে ফেলে। সেটা প্রাচ্যই হোক আর পাশ্চাত্যই হোক, কাশীরই হোক আর জার্মানিরই হোক- দুদিন ধরে তা কারও মনোরঞ্জন করতে পারে না। তারপরও ওইসব জিনিসে যে আজ সাহিত্যের বাজার ছেয়ে গেছে সেই কথা বোঝাতেই লেখক প্রশ্নোক্ত কথাগুলো বলেছেন। |
গ) নিজে করো। |
ঘ) নিজে করো। |
ক) প্রমথ চৌধুরীর ছদ্মনাম বীরবল। |
খ) মনোরঞ্জন আর আনন্দের মধ্যে আকাশ-পাতাল প্রভেদ। খেলাধুলায় যেমন নিছক আনন্দই প্রধান, সাহিত্যেও তাই। খেলাধুলায় যেমন আনন্দ ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই, সাহিত্যের উদ্দেশ্যও তেমনই- একমাত্র আনন্দদান করা। আনন্দ এক অনির্বচনীয় প্রাপ্তি, অন্তরাত্মার স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশেই তা অর্জিত হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে মনোরঞ্জন বিশেষ প্রণোদিত ও আরোপিত। মনোরঞ্জন করার মধ্যে কোনো একটা কৃত্রিম প্রয়াস বা বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে। |
গ) নিজে করো। |
ঘ) নিজে করো। |