মহাজাগতিক কিউরেটর
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
লেখক পরিচিতি :
নাম : মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
জন্ম ও পরিচয় : ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে ডিসেম্বর।
শিক্ষাজীবন : তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পিএইচডি ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন।
কর্মজীবন : সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞানও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে নিযুক্ত।
সাহিত্যকর্ম ও সম্মাননা : কিশোর উপন্যাস ‘দীপু নাম্বার টু’, ‘আমার বন্ধু রাশেদ' এবং ‘আমি তপু’ তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। এ ছাড়া ‘মহাকাশে মহাত্রাস', ‘টুকুনজিল’, ‘নিঃসঙ্গ গ্রহচারী’, ‘একজন অতিমানবী’, ‘ফোবিয়ানের যাত্রী' সহ অনেক পাঠকপ্রিয় সায়েন্স ফিকশন বা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির তিনি স্রষ্টা। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে বিজ্ঞান লেখক হিসেবে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।
সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তারা বেশ সন্তুষ্ট হলো। 🔒ব্যাখ্যা প্রথম প্রাণীটি বলল, ‘এখানে প্রাণের বিকাশ হয়েছে।' 🔒ব্যাখ্যা
'হ্যাঁ।'
‘বেশ পরিণত প্রাণ। অনেক ভিন্ন ভিন্ন ধরনের প্রজাতি। একেবারে ক্ষুদ্র এককোষী থেকে শুরু করে লক্ষ-কোটি কোষের প্রাণী।'
দ্বিতীয় প্রাণীটি আরও একটু খুঁটিয়ে দেখে বলল, ‘না। আসলে এটি জটিল প্রাণ নয়। খুব সহজ এবং সাধারণ।' 🔒ব্যাখ্যা ‘কেন? সাধারণ কেন বলছ? তাকিয়ে দেখ কত ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির প্রাণ। 🔒ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে ভাইরাস থেকে প্রকৃতপক্ষে ভাইরাসকে আলাদাভাবে প্রাণহীন বলা যায়। 🔒ব্যাখ্যা অন্য কোনো প্রাণীর সংস্পর্শে এলেই তার মাঝে জীবনের লক্ষণ দেখা যায়। তারপর রয়েছে এককোষী প্রাণ, পরজীবী ব্যাকটেরিয়া। তারপর আছে গাছপালা, এক জায়গায় স্থির। সালোকসংশ্লেষণ দিয়ে নিজের খাবার নিজেই তৈরি করে নিচ্ছে। 🔒ব্যাখ্যা পদ্ধতিটা বেশ চমৎকার। 🔒ব্যাখ্যা গাছপালা ছাড়াও আছে কীটপতঙ্গ। তাকিয়ে দেখ কত রকম কীটপতঙ্গ। পানিতেও নানা ধরনের প্রাণী আছে, তাদের বেঁচে থাকার পদ্ধতি ভিন্ন। ডাঙাতেও নানা ধরনের প্রাণী, কিছু কিছু শীতল রক্তের কিছু কিছু উষ্ণ রক্তের। উষ্ণ রক্তের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের 🔒ব্যাখ্যা একটির ভিতরে আবার অত্যন্ত নিম্নশ্রেণির বুদ্ধির বিকাশ হয়েছে। কোথাও কোথাও প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।'
“কিন্তু সব আসলে বাহ্যিক। এই ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির মাঝে আসলে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই।' 🔒ব্যাখ্যা
প্রথম প্রাণীটি বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি না তুমি কেন এই পার্থক্যকে বাহ্যিক বলছ।
‘তুমি আরেকটু খুঁটিয়ে দেখ। এই ভিন্ন প্রজাতি কী দিয়ে তৈরি হয়েছে দেখ।
প্রথম প্রাণীটি একটু খুঁটিয়ে দেখে বিস্ময়সূচক শব্দ করে বলল, ‘তুমি ঠিকই বলেছ। 🔒ব্যাখ্যা এই প্রাণীগুলো সব একইভাবে তৈরি হয়েছে। 🔒ব্যাখ্যা সব প্রাণীর জন্য মূল গঠনটি হচ্ছে ডিএনএ দিয়ে, সব প্রাণীর ডিএনএ একই রকম, সবগুলো একই বেস পেয়ার দিয়ে তৈরি। সবচেয়ে সহজ এবং সবচেয়ে জটিল প্রাণীটির একই রকম গঠন। 🔒ব্যাখ্যা প্রাণীটির বিকাশের নীলনকশা এই ডিএনএ দিয়ে তৈরি করে রাখা আছে। 🔒ব্যাখ্যা কোনো প্রাণীর নীলনকশা সহজ, কোনো প্রাণীর নীলনকশা জটিল—এটুকুই হচ্ছে পার্থক্য।' 🔒ব্যাখ্যা
‘হ্যাঁ।’ দ্বিতীয় প্রাণীটি বলল, ‘আমরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব গ্রহ-নক্ষত্র ঘুরে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণীগুলোকে সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছি—কাজটি সহজ নয়। 🔒ব্যাখ্যা এই গ্রহ থেকেও সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণীটি খুঁজে বের করতে হবে—যেহেতু সবগুলো প্রাণীর গঠন একই রকম, কাজটি আরও কঠিন হয়ে গেল।' 🔒ব্যাখ্যা
‘সময় নষ্ট না করে কাজ শুরু করে দেওয়া যাক।' 🔒ব্যাখ্যা
'হ্যাঁ'।
‘এই ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়া বেশি ছোট, এর গঠন এত সহজ এর মাঝে কোনো বৈচিত্র্য নেই। 🔒ব্যাখ্যা
‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। আবার এই হাতি বা নীল তিমি নিয়েও কাজ নেই, এদের আকার বেশি বড়। সংরক্ষণ করা কঠিন হবে।' 🔒ব্যাখ্যা
‘গাছপালা নেওয়ারও প্রয়োজন নেই। 🔒ব্যাখ্যা এরা এক জায়গায় স্থির থাকে। যেখানে গতিশীল প্রাণী আছে সেখানে স্থির প্রাণ নেওয়ার কোনো অর্থ হয় না।' 🔒ব্যাখ্যা
‘এই প্রাণীটি সম্পর্কে তোমার কী ধারণা? এটাকে বলে সাপ।'
‘সাপটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক, 🔒ব্যাখ্যা কিন্তু এটা সরীসৃপ 🔒ব্যাখ্যা । সরীসৃপের দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত নয়, 🔒ব্যাখ্যা
কেমন যেন স্থবির হয়ে পড়ে। প্রাণিজগতে সরীসৃপ একটু পিছিয়ে পড়া প্ৰাণী ৷' 🔒ব্যাখ্যা
‘ঠিকই বলেছ। তা হলে সরীসৃপ নিয়ে কাজ নেই। 🔒ব্যাখ্যা
প্রথম প্রাণীটি বলল, “আমার এই প্রাণীটি খুব পছন্দ হয়েছে। এটাকে বলে পাখি। কী চমৎকার! আকাশে উড়তে পারে!”
দ্বিতীয় প্রাণীটি বলল, ‘হ্যাঁ, আমারও এটি পছন্দ হয়েছে। আমরা এই প্রাণীটিকে নিতে পারি। তবে—'
‘তবে কী?’
‘এদের বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে আমি খুব নিশ্চিত নই। 🔒ব্যাখ্যা আমাদের কি এমন কোনো প্রাণী নেওয়া উচিত নয় যারা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে, যারা কোনো ধরনের সভ্যতা গড়ে তুলেছে?”
‘ঠিকই বলেছ। তা হলে আমাদের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের একবার দেখা উচিত।' 🔒ব্যাখ্যা
‘এই দেখ একটা স্তন্যপায়ী প্রাণী। কী সুন্দর হলুদের মাঝে কালো ডোরাকাটা! এর নাম বাঘ।
‘হ্যাঁ প্রাণীটি চমৎকার। কিন্তু এটি একা একা থাকতে পছন্দ করে। একটা সামাজিক প্রাণী নিতে পারি না?'
‘কুকুরকে নিলে কেমন হয়? এরা একসাথে থাকে। দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়।
প্রথম প্রাণীটি বলল, ‘এই প্রাণীটিকে মানুষ পোষ মানিয়ে রেখেছে, প্রাণীটা নিজেদের স্বকীয়তা 🔒ব্যাখ্যা হারিয়ে ফেলছে। 🔒ব্যাখ্যা
“ঠিকই বলেছ, গৃহপালিত প্রাণীগুলোর মাঝে স্বকীয়তা লোপ পেয়ে যাচ্ছে। 🔒ব্যাখ্যা একটা খাঁটি প্রাণী নেওয়া প্রয়োজন। হরিণ নিলে কেমন হয়?'
‘তৃণভোজী প্রাণী। 🔒ব্যাখ্যা তার অর্থ জান?'
'কী?'
‘এদের দীর্ঘ সময় খেতে হয়। 🔒ব্যাখ্যা বেশির ভাগ সময় এটা ঘাস লতাপাতা খেয়ে কাটায়।'
‘ঠিকই বলেছ। আমরা দেখছি কোনো প্রাণীই পছন্দ করতে পারছি না।’ 🔒ব্যাখ্যা
‘আমার একটা জিনিস মনে হচ্ছে।'
'কী?'
‘এই গ্রহটিতে যে প্রাণীটি সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে সেই প্রাণীটি নিলে কেমন হয়?’ 🔒ব্যাখ্যা
‘কোন প্রাণীর কথা বলছ?'
'মানুষ।’
‘মানুষ?’
‘হ্যাঁ। দেখ এদের একটা সামাজিক ব্যবস্থা আছে। সমাজবদ্ধ 🔒ব্যাখ্যা হয়ে থাকে। 🔒ব্যাখ্যা এদের কেউ শ্রমিক, কেউ সৈনিক, কেউ বুদ্ধিজীবী।'
“ঠিকই বলেছ।’
‘এই দেখ এরা শহর-বন্দর-নগর তৈরি করেছে। কত বিশাল বিশাল নগর তৈরি করেছে।'
‘শুধু তাই না, দেখ এরা চাষাবাদ করছে। পশুপালন করছে।'
‘যখন কোনো সমস্যা হয় তখন এরা দলবদ্ধভাবে সেটা সমাধান করার চেষ্টা করে।'
‘নিজেদের সভ্যতা গড়ে তোলার জন্য এদের কত আত্মত্যাগ রয়েছে দেখেছ?' 🔒ব্যাখ্যা
‘কিন্তু আমার একটা জিনিস মনে হচ্ছে—'
'কী?'
‘তুমি কি সত্যিই বিশ্বাস কর মানুষ এই গ্রহের শ্রেষ্ঠ প্রাণী?' 🔒ব্যাখ্যা
‘তুমি কেন এটা জিজ্ঞেস করছ?”
‘এই পৃথিবীর দিকে তাকাও। দেখেছ বাতাসে কত দূষিত পদার্থ? কত তেজস্ক্রিয় পদার্থ? বাতাসের ওজোন স্তর কেমন করে শেষ হয়ে যাচ্ছে দেখেছ? গাছ কেটে কত বিস্তীর্ণ এলাকা ধ্বংস করেছে দেখেছ?'
‘এর সবই কি মানুষ করেছে?' 🔒ব্যাখ্যা
'হ্যাঁ।'
‘কী আশ্চর্য! আমি ভেবেছিলাম এরা বুদ্ধিমান প্রাণী।' 🔒ব্যাখ্যা
‘এরা একে অন্যের ওপর নিউক্লিয়ার বোমা ফেলছে। 🔒ব্যাখ্যা যুদ্ধ করে একজন আরেকজনকে ধ্বংস করে ফেলছে। 🔒ব্যাখ্যা প্রকৃতিকে এরা দূষিত করে ফেলেছে।' 🔒ব্যাখ্যা
’ঠিকই বলেছ।’
প্রাণী দুটি কিছুক্ষণ বেশ মনোযোগ দিয়ে মানুষকে লক্ষ করল, তারপর প্রথম প্রাণীটি বলল, ‘না মানুষকে নেওয়া ঠিক হবে না। 🔒ব্যাখ্যা এরা মাত্র দুই মিলিয়ন বছর আগে জন্ম নিয়েছে, কিন্তু এর মাঝেই শুধু যে নিজেদের বিপন্ন করেছে তাই নয়, পুরো গ্রহটিকে ধ্বংস করে ফেলার অবস্থা করে ফেলেছে।' 🔒ব্যাখ্যা
দ্বিতীয় প্রাণীটি বলল, মহাজাগতিক কাউন্সিল আমাদের কিউরেটরের দায়িত্ব দিয়েছে। আমাদের খুব চিন্তা-ভাবনা করে প্রাণীগুলো বেছে নিতে হবে। এই সুন্দর গ্রহ থেকে এ রকম স্বেচ্ছা ধ্বংসকারী প্রাণী আমরা নিতে পারি না। কিছুতেই নিতে পারি না। 🔒ব্যাখ্যা
প্রাণী দুটি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে এবং হঠাৎ করে প্রথম প্রাণীটি আনন্দের ধ্বনি দিয়ে ওঠে। 🔒ব্যাখ্যা দ্বিতীয় প্রাণীটি অবাক হয়ে বলল, 'কী হয়েছে?’
‘আমি একটি প্রাণী খুঁজে পেয়েছি। এরাও সামাজিক প্রাণী। 🔒ব্যাখ্যা এরাও দল বেঁধে থাকে। এদের মাঝে শ্রমিক আছে সৈনিক আছে। বংশ বিস্তারের জন্য চমৎকার একটা পদ্ধতি আছে। দেখ নিজেদের থাকার জন্য কী চমৎকার বিশাল বাসস্থান তৈরি করেছে!”
দ্বিতীয় প্রাণীটি বলল, “ঠিকই বলেছ। দেখ এরাও মানুষের মতো চাষাবাদ করতে পারে। মানুষ যেরকম নিজেদের সুবিধার জন্য পশুপালন করতে পারে এদেরও ঠিক সেরকম ব্যবস্থা রয়েছে।'
‘কী সুশৃঙ্খল প্রাণী দেখেছ?' 🔒ব্যাখ্যা
'শুধু সুশৃঙ্খল নয়, এরা অসম্ভব পরিশ্রমী, গায়ে প্রচণ্ড জোর, নিজের শরীর থেকে দশগুণ বেশি জিনিস অনায়াসে নিয়ে যেতে পারে।'
“হ্যাঁ। কোনো ঝগড়াবিবাদ নেই। কে কোন কাজ করবে আগে থেকে ঠিক করে রেখেছে। কোনো রকম অভিযোগ নেই, যে যার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।’
‘অত্যন্ত সুবিবেচক। আগে থেকে খাবার জমিয়ে রাখছে। আর বিপদে কখনো দিশেহারা হয় না। অন্যকে বাঁচানোর জন্য অকাতরে প্রাণ দিয়ে যাচ্ছে। '
‘মানুষের বয়স মাত্র দুই মিলিয়ন বছর, সেই তুলনায় এরা সেই ডাইনোসরের যুগ 🔒ব্যাখ্যা থেকে বেঁচে আছে। 🔒ব্যাখ্যা
‘প্রকৃতির এতটুকু ক্ষতি করেনি। 🔒ব্যাখ্যা আমি নিশ্চিত মানুষ নিজেদের ধ্বংস করে ফেলার পরও এরা বেঁচে থাকবে। 🔒ব্যাখ্যা পৃথিবী এক সময় এরাই নিয়ন্ত্রণ করবে।' 🔒ব্যাখ্যা
“ঠিকই বলেছ। তা হলে আমরা এই প্রাণীটাই নিয়ে যাই?'
‘হ্যাঁ। পৃথিবীর এই চমৎকার প্রাণীটা নেওয়াই সবচেয়ে সুবিবেচনার কাজ হবে।
দুজন মহাজাগতিক কিউরেটর সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহটি থেকে কয়েকটি পিঁপড়া তুলে নিয়ে গ্যালাক্সির অন্য গ্রহ-নক্ষত্রে রওনা দেয়, দীর্ঘদিন থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ঘুরে ঘুরে তারা গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী সংগ্রহ করছে।
ক) সব প্রাণীর ডি. এন. এ একইরকম বেস পেয়ার দিয়ে তৈরি। |
খ) মানুষকে শ্রেষ্ঠ প্রাণীর মর্যাদা দিতে অনিচ্ছুক বলে কিউরেটরদ্বয় নমুনা হিসেবে এ প্রাণীটিকে সঙ্গে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। কিউরেটরদ্বয় মহাজাগতিক কাউন্সিলের জন্য শ্রেষ্ঠ প্রাণীর নমুনা সংগ্রহ করতে পৃথিবীতে আসে। বিভিন্ন প্রাণীর মধ্য থেকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে মানুষকে নির্বাচন করতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত তারা পিছিয়ে যায় মানুষের স্বেচ্ছা-ধ্বংসকারী কার্যকলাপ দেখে। মানুষের নানারকম ধ্বংসাত্মক কাজকর্ম দেখে শ্রেষ্ঠ প্রাণীর নমুনা হিসেবে মানুষকে নিয়ে যেতে কিউরেটরদ্বয়ের অনিচ্ছায় উক্তিটিতে প্রকাশ পেয়েছে। |
গ) ‘মহাজাগতিক কিউরেটর’ গল্পে উদ্দীপকে বর্ণিত মানুষের আত্মবিনাশী কর্মকাণ্ডের দিকটি প্রতিফলিত হয়েছে। ‘আত্মবিনাশী’ শব্দটির অর্থ হলো নিজের কোনো সৃষ্টিকে বিচার বিবেচনার উর্দ্ধে গিয়ে নিজেই ধ্বংস করে ফেলা। আর প্রতিনিয়ত এ আত্মবিনাশী কর্মকাণ্ডের সাথে সাথে যুক্ত হচ্ছে পৃথিবীর মানুষ। বিবেকবোধ, মানবতার উর্ধ্বে গিয়ে মানুষ ধ্বংস করছে সভ্যতা। উদ্দীপকে মেধা, মনন, শ্রম, ভালোবাসা দিয়ে সভ্যতা, বংশধারা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আবার এ মানুষের ঘৃণায়, ক্রোধে, প্রতিশোধে, লোকালয়, সভ্যতা ধ্বংস হচ্ছে। মুহাম্মদ জাফর ইকবাল (১৯৫২) রচিত ‘মহাজাগতিক কিউরেটর’ গল্পে লেখক শ্লেষ ও পরিহাসের মিশ্যণ দিয়ে মানুষের আত্মধ্বংসী কার্যকলাপ এর কথা তুলে ধরে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। লেখক দেখিয়েছেন এখানে যে মাত্র ২মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে এসে কীভাবে মানুষ পৃথিবীতে বাসের অযোগ্য করে তুলেছে এবং তুলছে।
|
ঘ) ‘এই সুন্দর গ্রহের স্বেচ্ছা-ধ্বংসকারী প্রাণী একমাত্র মানুষই’- উক্তিটি একেবারে যথার্থ। ‘স্বেচ্ছা-ধ্বংসকারী’ অর্থ হলো বিচার বিবেচনার উর্ধ্বে গিয়ে নিজ খেয়াল খুশিমত ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হওয়া। ‘স্বেচ্ছা-ধ্বংসকারী’ কথাটির সাথেই উঠে আসে মানুষ নামের প্রাণীটির নাম। মানুষের ‘স্বেচ্ছা-ধ্বংসকারী’ কর্মকাণ্ডই তাকে ‘স্বেচ্ছা-ধ্বংসকারী’ প্রাণীতে পরিণত করেছে। উদ্দীপকে মানুষ তার শ্রম, মেধা, ভালোবাসা, প্রেম সবকিছু দিয়ে অরণ্যভেদ করে লোকালয় গড়ে তোলে। আবার সেই মানুষের ক্রোধ, হিংসা, ঘৃণা আর প্রতিশোধের অনলে মানুষের গড়ে তোলা লোকালয় অরণ্যে পরিণত হয়। মুহাম্মদ জাফর ইকবাল (১৯৫২) রচিত ‘মহাজাগতিক কিউরেটর’ গল্পে লেখক নানা প্রাণীর বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। কিন্তু শুধু ‘মানুষ’ নামের প্রাণীটির সন্ধান পাওয়া গেছে যারা একসাথে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি সভ্যতার আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এবং সভ্যতাকে ধ্বংস করে চলেছে। মানুষের এ স্বেচ্ছা-ধ্বংসকারী কার্যক্রমের জন্য মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মানুষই একমাত্র প্রাণী যে পৃথিবীকে বাসের অনুপযোগী করে তুলেছে এবং তুলছে। উদ্দীপকে ও গল্পে উভয় স্থানেই মানুষ একসাথে সৃষ্টিশীল ও ধ্বংসকারী হিসেবে দেখানো হয়েছে। সুতরাং আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, উদ্দীপক ও পটিত গল্পের আলোকে প্রশ্নোক্ত মন্তব্যটি একেবারে যথার্থ। |
ক) বিজ্ঞানকে উপলক্ষ্য করে কল্পনার বিস্তারে অসামান্যতা মুহম্মদ জাফর ইকবালের রচনার শ্রেষ্ঠ সম্পদ। |
খ) পিঁপড়ার পরাপকারী, সুবিবেচক ও সুশৃঙ্খল মনোভাবের কারণে মহাজাগতিক কিউরেটররা পিঁপড়াকে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী হিসেবে গ্রহণ করল। কিউরেটরদের মতে, পিঁপড়ারা সুশৃঙ্খল, পরিশ্রমী, সুবিবেচক ও পরেণামদর্শী। এরা বিপদে দিশেহারা হয় না। পরস্পর বিবাদেও লিপ্ত হয় না। এরা সামাজিক এবং সর্বোপরি, আত্মবিধ্বংসী নয়। এসকল বৈশিষ্ট্যের কারণে মহাজাগতিক কিউরেটররা পিঁপড়াকে গ্রহণ করল। |
গ) হ্যাঁ, ‘মহাজাগতিক কিউরেটর’ গল্পের কিউরেটরদের বিচারের আলোকে উদ্দীপকের কাক প্রাণীটিকে শ্রেষ্ঠ প্রাণী বলা যায়। শ্রেষ্ঠ প্রাণী হলো সেই প্রাণী যার মধ্যে সহমর্মিতা, বিবেচনাবোধ রয়েছে। যে প্রাণী সামাজিক, সুশৃঙ্খল। সভ্যতা পরিবেশ রক্ষায় যার অবদান রয়েছে। সর্বোপরি, যে প্রাণী স্বেচ্ছা-ধ্বংসকারী নয়। উদ্দীপকে কাক পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখে। কাক সামাজিক হওয়ায় উদ্দীপকে একটি কাককে আক্রশণ করায় বাকি ঝাক ছুটে আসে। তাদের মধ্যে সহমর্মিতা বিদ্যমান। তারা আত্মবিধ্বংসী নয়। মুহাম্মদ জাফর ইকবাল (১৯৫২) রচিত ‘মহাজাগতিক কিউরেটর’ গল্পে কিউরেটরদ্বয় শ্রেষ্ঠ প্রাণীর গুণাবলি হিসেবে সুশৃঙ্খলতা, বিবেচনাবোধ, সামাজিকতা, সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে অবদানকে আদর্শ হিসাবে নিয়েছে। মানুষের মধ্যে এসব গুণাবলি থাকলেও শুধু স্বেচ্ছা-ধ্বংসকারিতা থাকার জন্য তারা মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেনি। অন্যদিকে পিঁপড়া পরিণামদর্শী হওয়ায় ও তার মধ্যে এসব গুণাবলি থাকায় পিঁপড়া শ্রেষ্ঠ প্রাণী হিসাবে নির্বাচিত হয়েছে। রচনার কিউরেটরদের শ্রেষ্ঠ প্রাণী নির্বাচনের জন্য পর্যবেক্ষণকৃত বৈশিষ্ট্যগুলো উদ্দীপকে কাক প্রাণীটির মধ্যে বিদ্যমান। সুতরাং আলোচনার প্রেক্ষিতে উদ্দীপকের কাক প্রাণীটিকে শ্যেষ্ঠ প্রাণী বলা যায়। |
ঘ) ‘কর্মই শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক’ উদ্দীপক ও ‘মহাজাগতিক কিউরেটর’ কল্পকাহিনির আলোকে উক্তিটি যথার্থ ও তাৎপর্যপূর্ণ। শ্রেষ্ঠত্ব সর্বদাই নির্ধারিত হয় কর্মের মাধ্যমে। মানুষ কর্ম বা কাজই তার যোগ্যতার পরিচায়ক। ভালো কাজ যেমন মানুষকে মহান করে, তেমনই মন্দ কাজ মানুষকে ধ্বংসকারী হিসাবে পরিচিতি দেয়। কর্মের মাধ্যমে সমাজ, দেশ ও পৃথিবীতে মানুষের মর্যাদা নির্ধারিত হয়। উদ্দীপকে কাক পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার ক্ষেত্রে অনস্বীকার্য ভূমিকা পালন করে। তার এ কাজের জন্য বাসযোগ্য হয়ে আছে আমাদের এ পৃথিবী। মুহাম্মদ জাফর ইকবাল (১৯৫২) রচিত ‘মহাজাগতিক কিউরেটর’ গল্পে লেখক কাজ এর ওপর অধিক প্রাধান্য দিয়েছেন মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে। মানুষের স্বেচ্ছা-ধ্বংসকারী কাজের জন্যই মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করা হয়নি। অন্যদিকে পিঁপড়ার সুবিবেচনার সাথে, শৃঙ্খলতার সাথে একতাবদ্ধ হয়ে পরিবেশের ক্ষতি না করে কাজ করে যাওয়ার জন্য পিঁপড়াকে দেয়া হয়েছে শ্রেষ্ঠত্ব। উদ্দীপক ও পঠিত কল্পকাহিনি বিচার করলে দেখা যায় শ্রেষ্ঠত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে উভয় ক্ষেত্রে কাজের ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সুুতরাং আলোচনার প্রেক্ষিতে বরা যায়, প্রশ্নোক্ত মন্তব্যটি একেবারে যথার্থ। |
ক) ‘মহাজাগতিক কিউরেটর’ বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা জাতীয় রচনা। |
খ) মহাজাগতিক কিউরটেদ্বয়ের মানুষ বাদ দিয়ে নমুনা হিসেবে পিঁপড়া সংগ্রহ করার কারণ নিজেরা নিজেদের কিংবা অন্যদের কোনো ক্ষতি করে না। মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণী হওয়া সত্তে¡ও সৃষ্টির পাশাপাশি ধ্বংসলীলা চালায়। পৃথিবীকে হুমকির মধ্যে ফেলে পরিবেশ ও অনাবিল শান্তি ধ্বংস করে। কিন্তু পিঁপড়া কখনও দলছাড়া হয় না, ধ্বংস করে না। এমনকি পরিবেশ নষ্ট করে না। তাদের একাগ্রত ও দলীয় সমন্ধয়ের জন্য মহাজাগতিক কিউরেটরদ্বয় মানুষকে বাদ দিয়ে নমুনা হিসেবে পিঁপড়াকে সংগ্রহ করে। |
গ) কিউরেটরদের বিচারের আলোকে উদ্দীপকের বারন প্রাণীটি শ্রেষ্ঠ। মুহম্মদ জাফর ইকবালের বিজ্ঞানভিত্তিক রচনা ‘মহাজাগতিক কিউরেটর’ এ সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহ পৃথিবীতে পিঁপড়াকে শ্রেষ্ঠ প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। কেননা তারা ডাইনোসরের যুগ থেকেই পৃথিবীতে সুবিবেচকের সাথে অত্যন্ত পরিশ্রম করছে এবং পরোপকারী ভূমিকা রাখছে। মানুষের বিবেকীশক্তি থাকলেও তারা পৃথিবীর ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে। কিন্তু পিঁপড়ার প্রতিটি কাজ কল্যাণকামী ও উপকারী। উদ্দীপক থেকে জানা যায় বাননের সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা এবং মানুষের দায়িত্বহীনতার কথা। একদিন একটি বানর বিদুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেলে সকল বানর এক হয়ে শোক প্রকাশ করে এবং প্রতিশোধ নেয়ার আকাক্সক্ষায় বিদ্যুতের খুঁটিতে ঝাঁকুনি দিতে থাকে। কিন্তু যখন একটি মেয়ে দিবালোকে কলেজের যাওয়ার পথে দুষ্টু ছেলেদের কর্তৃক্ত উত্যক্ত হয় তখন মানুষ শুধু দাঁড়িয়ে তামাশা দেখতে থাকে এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতার পরিচেয় দেয়। সুতরাং কিউরেটরদের বিচারের আলোকে পিঁপড়ার মতোই উদ্দীপকে বর্ণিত বানররা শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিয়েছে। |
ঘ) “উদ্দীপক ও ‘মহাজাগতিক কিউরেটর’ রচনার আলোকে বলা যায় ইতিবাচক কর্মই শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক” মন্তব্যটি যথাযর্থ। সৌরজগতের তৃতীয় গ্রন্থে পিঁপড়াকে কিউরেটরদ্বয় নানাদিক বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ প্রাণী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। সাময়িকভাবে বিবেকীশক্তির জন্য মানুষকে শ্রেষ্ঠ প্রাণী বলে মনে হলেও নিজেদের কর্তব্যহীনতা ও ধ্বংসাত্মক কাজের জন্য নিকৃষ্ট প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু পরিশ্রমী, উপকারী প্রাণী পিঁপড়ার প্রতিটি পদক্ষেপ বা কর্মকাণ্ড অন্য প্রাণীদের কল্যাণে হয়ে থাক। অত্যন্ত সুসংহত ও সামজবদ্ধভাবে বাস করছে তারা। উদ্দীপকের বিদুৎস্পষ্ট হয়ে মারা যেতে দেখা যায় একটি বানরকে। এতে সকল বানর এক হয়ে শোকানুভূতি জ্ঞাপন করে এবং প্রতিশোধের আগুনে দাউ দাউ করে জ¦লতে থাকে। এখানে বানরদের ইতিবাচক ভূমিকা পরিদৃষ্ট হয়। কলেজে যাওয়ার পথে একটি মেয়ে উত্যক্ত হলে মানুষের নেতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়। এতে মানুষ চরম সামাজিক মায়াহীনতা ও নিকৃষ্ট মনের পরিচয় দিয়েছে। সুতরাং ‘মহাজাগতিক কিউরেটর’ রচনায় পিঁপড়াকে অধ্যবসায়, পরিশ্রম ও পরোপকারের বিষয়টি স্পষ্টভাবে জানা যায়। তারা সংঘবদ্ধ সচেতন একে অপরের বিপদে আপদের সঙ্গী। এসব কারণেই কিউরেটদ্বয় পিঁপড়াকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণীতে ভূষিত করেছেন। অনুরূপভাবে উদ্দীপকে বর্ণিত একদিন একটি বানর বিদুৎ স্পৃষ্ট হয়ে মারা গেলে সব বানর এক হয়ে শোক প্রকাশ করে এবং প্রতিবাদের নেশায় অগ্নিমূর্তি হয়ে উঠে। এদিকে কলেজে যাওয়ার পথে বদমাইশ ছেলেদের কর্তৃক একটি মেয়ে উত্যক্ত হলে কাজল তার বন্ধুদের নিয়ে প্রতিবাদ করে ভূমিকা রাখে ইতিবাচক। অতএব প্রশ্নোল্লিখিত মন্তব্যটি যথাযথ। |